তুমি – আমি

শ্রীশ্রীঠাকুর || প্রকাশ কাল - April 18 2018

হে আমার তুমি, তুমি চিরসুন্দর, শান্ত, অপরিম্লান, অতি – সুবিমল, পরম অপরিম্নন, অতি – সুবিমল, পরম প্রেমময়, আনন্দঘন চিরন্তন, চিরপুরাতন, চিরনবীন।

আর আমি চিরমলিন, নিবিড় আঁধার, অমাবস্যার সান্দ্র অন্ধকার, প্রেমগন্ধহীন, কঠোর, কর্কশ, তীব্র, উগ্র, নিষ্ঠুর, পাষাণ, বজ্র হতেও কঠিনতম। তোমার আলো সহ্য করতে পারি না তোমাকে আমার কালো দিয়ে মলিন করে কত ব্যথা পাই, ব্যথা দিই।

হে আমার তুমি! তুমি মুখ এটা অতি মলিন দর্পণ। এতে তোমার নির্ম্মল, সুশোভন, মৃদুহাস্য রমণীয় মুখখানিও মলিন দেখায়।

আজ একটা কথা তোমায় শুনাই তুমি ঠিকই চিরনবীন, চিরসুন্দর – আছ, ছিলে থাক্‌বে।

তোমাকে যথার্থরূপে কি করে দেখা যাবে, বুঝা যাবে ধরা যাবে সেই কথাই মনে কর্‌ছি। তুমি না কৃপা কর্‌লে তোমাকে ধর্‌তে পারবো না; বহুর মাঝে হারিয়ে ফেলে হাহাকার কর্‌ছি, করবো।

শোন আমার মনের কথা। হে দয়িততম! আমি পুত্র হই আর তুমি পিতা সাজ – আমি যদি তোমার কার্য্যের, তোমার পদ্ধতির, তোমার স্নেহ ভালবাসার সমালোচনা করে তেমাকে দোষ দিই – বিদ্যার্জ্জনে ধনার্জ্জনে স্বীয় সামর্থ্য প্রকট করি সে তোমার দোষ নয়, সে আমার মলিন্‌ চিত্ত দর্পণের। তুমি চির অমল, চির জাজ্জ্বল্যমান, অতি পবিত্র, বিশুদ্ধ পাবন।

পক্ষান্তরে আমি পিতা তুমি যদি পুত্র সাজ – আর আমি পুত্ররূপী তোমার অশেষ দোষ আবিষ্কার করি – তোমার পিতৃভক্তি নাই, তুমি অবিনীত, অবাধ্য, পিতৃদ্রোহী বলি, তাহলে তা এ মলিন চিত্তদর্পণের দোষ! তুমি চিরসুন্দর মনোরম, অভিরাম, পাবনতম – দোষ আমার। হে বাঞ্ছিততম! তুমি যদি অগ্রজ সাজ আর আমি অনুজ হয়ে তোমার দোষ খুঁজে খুঁজে বের করতে থাকি, অগ্রজ স্নেহহীন, স্বার্থপর, আমার দ্বারা কেবল স্বার্থসিদ্ধি কর্‌তে চান্‌ বলি – সে দোষ তোমার নয়, আমার। তুমি অগ্রজ চিরনির্ম্মল, চিরসুন্দর, সুললিত, সুশোভন, পরম পাবনতম।

তোমার লেশমাত্র দোষ নাই।

আবার তুমি যদি অনুজ সাজ আর আমি অগ্রজ হয়ে তোমার ত্রুটি, তোমার শত শত দোষ প্রকাশ করি তোমার ভক্তিহীনতা, তোমার কুটিলতা, স্বার্থ – পরতার কথা প্রচার করতে থাকি সে দোষ আমার – আমার মলিন দৃষ্টির সমল চিত্তের। তুমি ঠিকই লক্ষ্মণের ও ভরতের ন্যায় ভ্রাতা। আমি আমার মহামলিন চিত্তের দোষে তোমার দোষ প্রকটিত করে বুকের ব্যথায় সারা হই।

হে সুচির – ঈপ্সিত! হে প্রাণেশ্বর! তুমি যদি পতি সাজ এবং আমি পত্নী হয়ে তোমার ভালবাসার, তোমার প্রেমের নিন্দা করে কর্কশ ব্যবহারের কথা লোকসমাজে বলে বেড়াই, অতি হৃদয়হীন, দুঃশীল, দুর্ম্মুখ পতি বলে যন্ত্রণা ভোগ করি – সে দোষ আমার। তুমি চিররমণীয়, মোহনীয়, কমনীয়, বরণীয় – অতি পাবনতম। তোমাকে মলিন করি আমার মহামলিন চিত্তের কালিমা দিয়ে। আর তুমি যদি পত্নী সাজ আমি স্বামী হই এবং আমি যদি কেবল তোমার দোষ দর্শন করে তোমাকে লাঞ্ছনা করতে থাকি, কষ্ট দিই, জনসমাজে অতি দুষ্টা বলে, মুখরা ভক্তিহীনা বলে প্রচারে রত হই – হে মহাবিশুদ্ধ! হে প্রিয়তম! সে দোষ তোমার নয় – আমার মলিন, সান্দ্র – অন্ধকার চিত্তদর্পণের।

হে ঈপ্সিততম! তুমি গুরু সাজ এবং আমি শিষ্য হয়ে তোমার দোষ, তোমার ভালবাসার বৈষম্য দেখি – তোমার পক্ষপাতিত্ব এবং আমার প্রতি অকৃপার কথা সকলকে জানাই – সে দোষ তোমার নয় – তা আমার নিবিড়, ঘন অন্ধকারে গড়া চিত্তদর্পণের।

পক্ষান্তরে তুমি শিষ্য সাজ আর আমি গুরু হই এবং কেবল তোমার সেবার ত্রুটি, ব্যবহারের দোষ, তোমার কায় – বাক্য – মনের দুষ্টতা সতত আবিষ্কার করে, অযোগ্য অধম শিষ্যের যন্ত্রণায় সারা হই – সে দোষ তোমার নয়, আমার এ গাঢ় অন্ধকারে গড়া দুষ্ট চিত্তের।

প্রিয় হে! যা কিছু সব তুমি! অতি সুনির্ম্মল, চিরসুন্দর, চিরসুশীতল। আমি আমার মলিন মানস – দর্পণে শ্রীহীন ছবি অঙ্কিত করে যন্ত্রণা পাই, কত কথা বলি, নিন্দা করি, হৃদয়ের জ্বালায় অস্থির হই।

হে অতি মহাপাবন! হে অপাপবিদ্ধ নিত্য শুদ্ধ। হে দয়িত! তুমি এ চিত্তকে পরিপূত করে দাও – নচেৎ কেবল আঘাতের পর আঘাত দিয়ে তোমাকে ব্যথিত করে চলেছি কত কাল, আরও চলবো কত জন্ম? শুধু বুঝিয়ে দাও জানিয়ে দাও – দোষ কারও নয় – দোষ আমার। অপরের দোষ দর্শন দূর করে দাও প্রিয় – দাও নাথ! আমাকে আমার নিজের দোষদর্শনে নিরন্তর নিরত রাখ।

কি আশ্চর্য্য! আমি নিজে ভালবাসি না আর বলি আমুক আমায় ভালবাসে না। আমি ভালবাসি না বলে তার ভালবাসা বুঝতে পারি না। যে মুহূর্ত্তে আমি তাকে ভালবাসবো দেখবো সে আমায় কত ভালবাসে। সে যে আর কেউ নয়, ছদ্মবেশী তুমি।

হে নটচূড়ামণি প্রিয়তম! একমাত্র তুমিই আছ আকাশ হয়ে পর্ব্বত হয়ে নদনদী, বৃক্ষ্মলতা, পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ, গো, গর্দ্দভ, বানর, ভল্লুক, ভুত – প্রেত, পিশাচ, দানব, মাবন, গন্ধর্ব্ব কিন্নর আদি যা কিছু দৃশ্যজাল তুমিই সব সেজে বিরাজ করছো। আর আমি আমার মলিনতম চিত্ত দিয়ে তোমাকে আলাদা আলাদা দেখে সংসার রচনা করছি। একমাত্র চিরমধুময় শান্তময় প্রেমময় তোমাকে পৃথক পৃথক ইন্দ্রিয় দিয়ে স্বতন্ত্র – ভাবে গ্রহণ করছি। সেই দয়িততম তোমাকে চক্ষু দিয়ে রূপ বলে নিচ্ছি, কর্ণের দ্বারা শব্দ বলে, ত্বকের দ্বারা স্পর্শ বলে, নাসিকার দ্বারা গন্ধ, জিহ্বার দ্বারা রস বলে গ্রহণ করছি – কিন্তু মূলে সেই এক পরম সত্য পরম প্রেমময়, আনন্দময়, আমার মনের মন, প্রাণের প্রিয়তম তুমি।

হে আমার সকল সাধনের সাধ্য, দয়িততম! পড়ি, শুনি, অভ্যাসের চেষ্টা করি – কিন্তু হে প্রাণ বল্লভ! তোমার করুণা ভিন্ন তো তোমাকে যথার্থ-ভাবে গ্রহণ করতে পারবো না। কৃপা কর প্রিয়তম! সকল সেজে তুমি আছ। তুমি আমাকে পবিত্র করবার জন্য, তোমার করে নেবার নিমিত্ত, তোমাতে মেশাবার জন্য সতত ব্যাকুল! আমায় বুঝিয়ে, জানিয়ে, বিশ্বাস করিয়ে দাও আমি যেন কারো দোষ দর্শন না করি। ‘‘সব তুমি’’ একথা মনে প্রাণে বুঝে তোমার গুণগানে যেন অনুক্ষণ রত থাকি। আমি যেন নিজের দোষ দর্শন করে একটি একটি দোষ ধরে ধরে তোমার চরণে সমর্পণ কর্‌তে সমর্থ হই। দোষের দ্বারা তোমার পূজা করে তোমার হয়ে যাই –

নত কর যত কর করহে তোমার।

কেড়ে নাও প্রিয়তম মোর অহঙ্কার।।

আমার আমিরে নাও তোমার করিয়া!

আমি – হারা হয়ে থাকি তোমার হইয়া।।