ললনামঙ্গল গীতামৃত বা শ্রীকৃষ্ণ-উত্তরা সংবাদ


ত্রয়োদশ অধ্যায়

চির কৌমার্য্যাবলম্বন যোগ

উত্তরা –

পরম দয়াল তুমি পতিত পাবন।

এত দিনে সত্য বুঝিলাম নারায়ণ।।

পতিতার করিলে যে সদগতি বিধান।

সত্য সত্য শুনি তাহা জুড়াইল প্রাণ।।

মোরা অজ্ঞ লভি নাই সম দরশন।

তাই বুঝি ত্যাজ্য কেহ পূজ্য কোন জন।।

কিন্তু প্রভো তব কাছে সম সমুদয়।

তব কৃপা লাভে কেহ বঞ্চিত না হয়।।

মোরা পারি পতিতারে ঠেলিতে চরণে।

তুমি না করিলে দয়া পারিবে কেমনে।।

ভাল শিক্ষা দিলে তুমি পতিতার তরে।

শুনাইব এই গাথা দীনা ভগ্নীদেরে।।

সকলে মিলিয়া তব সেবিব চরণ।

হবে এ তৃষিত মরু রসাল নন্দন।।

তোমার মধুরবাণী শুনিতে শুনিতে।

কত তৃপ্তি পরিতোষ শান্তি আসে চিতে।।

এইভাব লয়ে যেন ফুরায় জীবন।

তোমার চরণে মোর এই নিবেদন।।

কিবা কাজ খেলি আর সংসারের খেলা।

পারে যেতে লভিয়াছি তুমি সত্য ভেলা।।

কত তত্ত্ব জানাইয়ে পুরাইলে আশ।

আরো কত জানিবার জাগে অভিলাষ।।

অবলার বল তুমি দীনের বান্ধব।

দীনে ত্রাণ করি রাখ নামের গৌরব।।

যে তত্ত্ব এখন প্রভো জিজ্ঞাসি তোমারে।

সদুত্তর করি দান তৃপ্ত কর মোরে।।

থাকিতে চিরকুমারী যদি কেহ চায়।

দয়া করি বল তার কি হবে উপায়।।

কি আচারে কি নিয়মে যাপিবে জীবন।

কি বাধানে করিবে সে তোমার সাধন।।

ইন্দ্রিয় তৃষ্ণা রাক্ষসী যখন আসিবে।

তখন তাহারে বলো কি অস্ত্রে নাশিবে।।

বড় সাধ করিবে সে কৌমার্য গ্রহণ।

তুমি যদি কর এবে বাসনা পূরণ।।

শুনি সবে বলে তোমা বাঞ্ছা কল্পতরু।

চিরকুমারীর বাঞ্ছা পূর্ণ কর গুরু।।

 

শ্রীকৃষ্ণ –

ভয় নাই সকলের আশা পূর্ণ হবে।

অতৃপ্ত রবে না কেহ আমি আছি ভবে।।

আমি করি সকলের সদ্‌গতি বিধান।

বিশ্বের আশ্রয় আমি পরম কল্যাণ।।

আমায় ধরিলে কারো ন হবে পতন।

অচিরে লভিবে প্রাণে নিত্য সত্য ধন।।

যতই কঠিন হউক সে চির কোমার্য।

আমায় ধরিলে ত্বরা সিদ্ধ হবে কার্য।।

আমাকে ভুলিয়ে কেহ মাতি অহঙ্কারে।

ইন্দ্রিয় সংগ্রামে কভু জয়ী হতে নারে।।

বীরত্ব দেখাতে গিয়ে হারায়ে সংযম।

কতবার ঘুরি শেষে বুঝিয়াছে ভ্রম।।

ইন্দ্রিয়দমন নহে সহজ ব্যাপার।

যে পারে সাধিতে তাহা সে প্রিয় আমার।।

সতত ইন্দ্রিয়গণে বেষ্টিত থাকিয়ে।

হেন শক্তি কার রহে নির্লিপ্ত হইয়ে।।

জলেতে বসতি করি নীরে না ভিজিবে।

ব্যঞ্জন বাঁটিবে গিন্নী হাঁড়ি না ছুঁইবে।।

দুঃসাধ্য সাধিতে হেন পারে কোন জন?

আমার রসিক ভক্ত জানে সে সাধন।।

যে হবে আমার ভক্ত চতুর সে হয়।

কত সে অসাধ্য ভবে সাধন করয়।।

সুমেরু শিখর পারে সূতায় গাঁথিতে।

মাকড়সা জালে পারে মাতঙ্গ বাঁধিতে।।

আমার ভক্তের তত্ত্ব বর্ণিতে কে পারে।

সে পারে সাপের মুখে নাচাতে ভেকেরে।।

তাই সে চিরকুমারী থাকিতে যে চায়।

সকল ভুলিয়া যেন ধরে সে আমায়।।

আমা ভিন্ন অন্যে যেন নাহি থাকে মন।

সতত সর্ব্বত্র মোরে করিবে দর্শন।।

আমার ভক্তিতে চিত্ত রাখি ভরপুর।

আমায় ভজিয়ে বালা হইবে চতুর।।

আমাকে ভুলিয়া যদি ক্ষণমাত্র রয়।

অমনি রাক্ষসী মায়া ভুলাবে নিশ্চয়।।

ক্ষণমাত্র হলে চ্যুত মম ভাব হতে।

অমনি বাঁধিবে রিপু কি সাধ্য এড়াতে।।

আমা হতে ক্ষণতরে ফিরালে নয়ন।

অমনি বঞ্চিবে ইন্দ্রয়ের প্রলোভন।।

আমি ব্রহ্ম আমাতে যে করে বিচরণ।

হইতে ব্রহ্মচারিণী পারে সেই জন।।

মম চিন্তা মম ধ্যানে মগ্ন যেই রয়।

হয় তারি ব্রহ্মচর্য কৌমার্য অক্ষয়।।

আমাতে যে চিত্ত রেখে নিত্য করে বাস।

সিদ্ধ তার সর্ব্ব কর্ম্ম ব্রত উপবাস।।

আমাকে চিন্তিতে সদা সমর্থা যে নয়।

তাহার চিরকৌমার্য কভু বৈধ নয়।।

তবে খেয়ালের বশে করিলে গ্রহণ।

অদৃষ্টে লাঞ্ছনা ভোগ কে করে বারণ।।

করিয়া আত্মপরীক্ষা বুঝিবে যখন।

আমা হতে তিলমাত্র নাহি টলে মন।।

কুমারী ভোগ বাসনা বর্জ্জিয়া তখন।

চির কুমারীর ব্রত করিবে গ্রহণ।।

তা না হলে এই ব্রতে বিপদ নিশ্চয়।

দুরন্ত ইন্দ্রিয় বশ সহজে কি হয়।।

এক রক্ত মাংসে গড়া সকল শরীর।

একই স্বভাবে হয় সকলে অস্থির।।

সমান বয়সে জাগে সমভাব মনে।

প্রকৃতির গতিরোধ করিবে কেমনে।।

দৈব গুণময়ী এই প্রকৃতি আমার।

আমাতে প্রপন্ন হলে হতে পারে পার।।

তা না হলে পারে যেতে অন্য পন্থা নাই।

এই নীতি ধরি নিত্য চলিবে সবাই।।

 

উত্তরা –

এ জীবনে আর প্রভো তোমা না ছাড়িব।

চরণে শরণ নিয়ে আনন্দে রহিব।।

তুমি মোর ব্রহ্মচর্য ধর্ম্ম কর্ম্ম সব।

কভু আমি না ভুলিব তোমারি গৌরব।।

তোমা নিত্য না হেরিলেও হে অন্তর্যামী।

আঁখি মেলি কারো পানে না চাহিব আমি।।

নিয়ত না শুনি যদি তোমারি বচন।

শুনিব না অন্য কথা পাতিয়া শ্রবণ।।

তোমার প্রসাদ ভবে যদি নাহি পাই।

রসনায় তুলিয়া কি নিব ভস্ম ছাই।।

শোক তাপ দৈন্য ব্যথা করিতে বারণ।

জ্বালিয়ে কি বহ্নি বুকে করিব ধারণ।।

ত্যজিয়ে কি সুবাসিত প্রেম পরিমল।

মাখিব এ অঙ্গে মম ক্লেদ মূত্র মল।।

হবে না হবে না তাহা জীবনে কখন।

থাকিব তোমারে লয়ে হৃদয় রতন।।

যাহারা চির কৌমার্য করিবে গ্রহণ।

এ কথা তাদের কাছে করিব কীর্ত্তন।।

শুনিয়া লভিবে তারা হিতাহিত জ্ঞান।

চিনি নিজ নিজ পথ হবে আগুয়ান।।

তব তত্ত্ব উপদেশ দীপ হাতে লয়ে।

পৌঁছিব গন্তব্যস্থানে সিদ্ধকাম হয়ে।।

 

শ্রীকৃষ্ণ –

পুনঃ বলি সেই তত্ত্ব কল্যাণি তোমারে।

সতত গাঁথিয়া তাহা রাখিবে অন্তরে।।

থেকে থেকে বিষয়েতে ধায় যার মন।

ইন্দ্রিয় নিরোধ যেন করে না সে জন।।

সে যেন ভোগের সনে করয়ে বিচার।

সংসার বিষয় সুখ অনিত্য অসার।।

রূপাদি হইতে ধীরে অভ্যাসের বলে।

প্রত্যাহার করি মন ফিরাবে কৌশলে।।

পরে সে অনন্যা ভক্তি লভিবে আমাতে।

মায়া মোহ আর নাহি পারিবে ভুলাতে।।

শুনেছ করেছি আমি কালিয় দমন।

ব্রজধামে বাল্যখেলা খেলেছি যখন।।

তাই মোরে রাখ তব হৃদি-বৃন্দাবনে।

দুষ্ট কাম কালিয়ের দমন কারণে।।

কাল মুখে কাম সদা ঢালিছে গরল।

অস্পৃশ্য অপেয় প্রীতি যমুনার জল।।

যদি নাহি শিরে তার করি পদার্পণ।

হবে না হবে না সেই দুষ্টের দমন।।

যখনি পশিব আমি কালিন্দীর নীরে।

করিব তান্ডব নৃত্য উঠি তার শিরে।।

তখন হইবে কাম কালিয় দমন।

আমি ভিন্ন এই কার্য কে করে সাধন।।

অতএব আমা কভু না হয়ে বিস্মৃত।

দুঃখ ভুলিবারে হও আমার আশ্রিত।।

আমা ধরি যত ইচ্ছা কর ভব খেলা।

কাঁদিতে হবে না বসি ফুরাইলে বেলা।।

হও তুমি সতীলক্ষ্মী অথবা অসতী।

আমা হতে নাহি যেন টলে তব মতি।

হও সে ব্রহ্মচারিণী অথবা গৃহিণী।

আমাতে রাখিবে ভক্তি অব্যভিচারিণী।।

জীবন মরণ কিছু করিও না জ্ঞান।

মম ভাবে রেখো সদা ভরপুর প্রাণ।।

আমি ব্রহ্ম আমা হতে বড় কে সংসারে।

আমি বিষ্ণু আমি একা ব্যাপ্ত চরাচরে।।

আমি সৎ আমি চিৎ আমি সে আনন্দ।

আমায় ভাবিলে নাহি রবে নিরানন্দ।।

আমি সত্য আমি নিত্য আছি আমি একা।

যে লভে ভাবের আাঁখি সেই পায় দেখা।।

তুমি যে স্বাধীন মুক্ত জান এই কথা।

তত্ত্বজ্ঞান ভুলি আর কেন পাও ব্যথা।।

অবিদ্যার যবনিকা করি উন্মোচন।

সংসার স্বপ্নের ছবি কর দরশন।।

পারে কি ফুটিতে ফুল আকাশের গায়?

পারে কি হইতে রাজা বন্ধ্যার তনয়?

পারে পারে পারে তাহা কভু মিথ্যা নয়।

এ জগৎ দেখিয়ে কি হয় না প্রত্যয়।।

জ্ঞান বিচারেতে যার সত্তা নাহি পাও।

হেন বস্তু এ জগতে কিবা সত্য চাও।।

এ যে ঐন্দ্রজালিকের হাতের সাফাই।

রজ্জু দেখে সর্প ভয়ে শঙ্কিত সবাই।।

হ’য়ে সবে আত্মভোলা অভিনয়ে রত।

বিষয় খেলনা লয়ে খেলে অবিরত।।

খেলিতে এ ভবখেলা সহিতেছ জ্বালা।

প্রহারে নাহিক লজ্জা পুনঃ চাহ খেলা।।

স্বপ্নাবেশে কোনো দেশে করিয়া গমন।

সুখে দুঃখে কত যেন কর বিচরণ।।

স্বপন টুটিলে কিছু দেখ কি তথায়?

জান কি সে দৃশ্য হয় বিলীন কোথায়?

বিষয়ে বিরাগী কেহ ছাড়িছে সংসার।

জানি না কি ছাড়ে তবে নাহি কিছু যার।।

ত্যজ্য গ্রাহ্য তুল্য দুই সবই শূন্যময়।

ভেবে দেখ মনে স্বপ্নদৃষ্ট সমুদয়।।

এ হেন সংসার পুনঃ যে বা ভালবাসে।

নিশ্চয় জানিবে সে যে বাঁধা ভ্রান্তি পাশে।

যে ইহারে দোষে সদা যেবা করে দ্বেষ।

সেও ত’ অভ্রান্ত নয় জান সবিশেষ।।

কে কলত্র কেবা পুত্র, কে পিতা কে মাতা।

কে ভ্রাতা কে বন্ধু তব, কেন এ মমতা।।

সত্য নহে বহুরূপ কেন বৃথা ভজ।

অল্প ত্যাজি সুখময় ভুমাতেই মজ।।

এক ভুলি বহুরূপ যে করে দর্শন।

করে সে মৃত্যু হতে মৃত্যু আলিঙ্গন।।

প্রপঞ্চ বিকার বহু জানিবে নিশ্চয়।

অমৃত স্বরূপ তুমি কেন মৃত্যুভয়।।

পুনঃ পুনঃ বলি ধর এই তত্ত্বজ্ঞান।

এ শুদ্ধ বৈরাগ্য লয়ে কর অবস্থান।।

যে লভিবে আত্মরতি  বৈরাগ্য বলে।

সে যেন চিরকুমারী থাকে ইচ্ছা হলে।।

প্রধান কর্ত্তব্য তার মম চিন্তা ধ্যান।

ভবের কল্যাণ হেতু আত্ম বলিদান।।

মুখে সদা মম নাম করিবে কীর্ত্তন।

মানসে আমায় নিত্য করিবে স্মরণ।।

দেখিবে আমারি রূপ নয়ন মেলিয়ে।

শুনিবে আমারি কথা শ্রবণ পাতিয়ে।।

আমারি নির্ম্মাল্য গন্ধে নাসা মুগ্ধ হবে।

রসনা প্রসাদে মম সদা তৃপ্ত রবে।।

সকল পরশে পাবে আমার পরশ।

রাখিবে আমারি রসে হৃদয় সরস।।

আমি এক ভূমা আত্মা তুমিও যে আমি।

এই জ্ঞানে হও সদা মম অনুগামী।।

জীবন আমার ভাবে কর মধুময়।

মরণে পরম পদে লভিবে আশ্রয়।