সর্ব্বদা যে নাম করে তা’কে ফেলবার সাধ্য কারও নাই
যদি বিশ্বাস না করতে পারো তাতেও কোন ক্ষতি নাই। নাম কর, নাম আপনার প্রাভাব দেখাবেন।
বিশ্বাস না করতে পারলে তাঁর কৃপা কি করে পাওয়া যাবে?
বস্তুশক্তি কারও বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভক্তির অপেক্ষা না রেখে আপনার শক্তি প্রদর্শন করে। নামও সেইরূপ করেন।
কথাটা ঠিক বুঝলাম না।
ধর যদি কেউ অবিশ্বাস ক’রে নাইট্রিক এ্যাসিড গায়ে ঢালে অথবা আলকুসি বা বিচুটী গায়ে মাখে কিম্বা সাপের বিষ খায় বা আগুনে হাত দেয়, তাহ’লে তার বিশ্বাস নাই বলে কি নাইট্রিক এ্যাসিড প্রভৃতি কোন কাজ করবে না?
করবে বৈ কি! তারা স্ব স্ব শক্তি দেখাবে।
তবেই বোঝ যদি সামান্য প্রাকৃত পদার্থ সর্ব্বত্র অবাধে আপানার শক্তি প্রদর্শন করে, কোন সময় স্বীয় শক্তি সঙ্কোচ করে না, তখন অনন্ত-প্রভাবসম্পন্ন সচ্চিদানন্দময় নাম অবিশ্বাসীকে কেন আত্মসাৎ করবে না? ছোট ছোট ছেলে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ব’লে কি আগুন গাদাকে ভস্মীভূত করবে না?
তা করবে!
তাহ’লে যেমন করে পারো হেলায়-শ্রদ্ধায়, বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে নাম করে যাও, অবশ্যই কৃপা পাবে। তাহ’লে নাম করতে হ’লে, শ্রদ্ধাভক্তি কিছুরই প্রয়োজন নাই?
নাম ভক্তি, শ্রদ্ধা, প্রেম, বিশ্বাসের কাঙ্গাল নন। তিনি ভক্তি, শ্রদ্ধা প্রেমের অনন্ত পারাবার।
যেন কেন প্রকারেণ নামমাত্রস্য জল্পকাঃ-
যে কোন প্রকারে হোক, যারা নাম করে তারা অনায়াসে পরম সুখে যে পরমাগতি প্রাপ্ত হয় তা সমস্ত ধর্ম্মানুষ্ঠানকারিগণ পায় না।
হরিহরতি পাপানি দুষ্টাচিত্তৈরপি স্মৃতঃ।
অনিচ্ছয়াপি সংস্পৃষ্টো দহত্যেব হি পাবকঃ।।
বিষ্ণুরহস্যে
অনিচ্ছাক্রমে যদি কেহ অগ্নি স্পর্শ করে তাঁহলে সে যেমন পুড়ে যায় তদ্রূপ দুষ্টচিত্তগণ ইচ্ছা না ক’রে স্মরণ করলেও পাপ সকল নষ্ট হয়।
অনিচ্ছা ক’রে স্মরণ – সে কেমন?
একজন বৈষ্ণবকে দেখে কোন দুষ্ট-চিত্ত ব্যক্তির মনে হ’ল – এ বেটা খুব হরিনাম করে। এই অনিচ্ছায় স্মরণেও পাপ দূর করে।
সাঙ্কেত্যাং পরিহাস্যং বা স্তোভং হেলনমেব বা।
বৈকুন্ঠ নাম গ্রহণমশেষাঘহরং বিদুঃ।।
ভাগবত
সঙ্কেত ক’রে, অর্থাৎ কারো নাম গোবিন্দ, তাকে ‘‘গোবিন্দ’’ ব’লে ডাকলে; পরিহাস মানে বিরূপ, – কোন ভক্ত নাম করেন তাঁকে দর্শন করে ‘‘জয় রাধে রাধে গোবিন্দ বল’’ – এমনভাবে; স্তোভ অর্থে সামবেদ পাদপুরণের জন্য হাবু ইত্যাদি গান করেন, তার কোন অর্থ নাই, তদ্রূপ নিরর্থক যদি কেহ ‘‘হরি হরি’’ বলেন; হেলা ক’রে – ‘‘আরে রাম রাম ছিছি’’ – এমনভাবেও যদি কেহ শ্রীভগবানের নাম গ্রহণ করে তা-হ’লে তার অশেষ পাপ নষ্ট হয়।
একটি সত্য ঘটনা বলি। বর্দ্ধমান জেলায় কোন মাতালের গ্রামে জনৈক বৈষ্ণব করতাল বাজিয়ে নাম করতে করতে উপস্থিত হলেন। মাতালের দল একটা নতুন জিনিস পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করলে এবং বাবাজীর সঙ্গে মনে মনে দুচার বার ‘‘হরে কৃষ্ণ’’ বলেও ফেল্লে। শ্রীনাম তাদের কৃপা করবার জন্য ধীরে ধীরে আপনার প্রভাব দেখাতে লাগলেন। তার মধ্যে কোন মাতাল বল্লে, – ‘‘বাবাজী, তুমি এখানে থাকো’’। বাবাজী রয়ে গেলেন। নাম করতে আরও আকর্ষণ করলে। তম্নধ্যে 2/4 জন মাতাল বললে, ‘‘বাবজী আমাদের মন্ত্র দেবেন?’’ বাবাজী বল্লে, ‘‘না বাবা, আমার মন্তর টন্তর দেওয়া অভ্যাস নাই’’। তাদের আগ্রহ বাড়ল – তা’রা বললে, ‘‘না আপনাকে মন্ত্র দিতেই হবে’’। বাবাজী গতিক ভাল নয় দেখে বল্লে, – ‘‘দেখ, আমার ওসব জানা নেই। মন্ত্র নেবে তো চল আমার গুরুদেবের কাছে চল’’। নামের কৃপা তাদের হয়েছে। তা’রা গিয়ে বাবজীর গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়ে এল। ক্রমে নাম সে গ্রাম, পার্শ্ববর্ত্তী গ্রামে তরঙ্গ তুললেন। বাবাজীকে তা’রা গ্রামে চাতুর্মাস্য করালে। নাম চতুস্পার্শবর্ত্তী গ্রামগুলিতে নৃত্য করতে লাগলেন।
‘‘বাবাজী বাবা আমাদের নূতন জীবন দিয়েছেন।’’
এখন সেই গ্রামের কাছে একটি আশ্রম হয়েছে। বৎসর বৎসর উৎসবে বহুলোক নাম নিয়ে আনন্দ কর্ছে।
আচ্ছা, নামের কৃপা সমভাবে সকলের উপর হয় না কেন? দেখা যায় কোন গ্রামে নাম হয়, একদল নাম করে, অন্যদল তাদের উপহাস করে। নাম কেন সকলকেই কৃপা করেন না? নাম সকলকেই কৃপা করেন। যাদের অধিক পাপ, তামসিক, রাজসিক প্রকৃতির লোক, তারাও কৃপা পায়, তবে জন্মান্তরীয় দুষ্কৃতির জন্য নাম সরলভাবে কর্তে পারে না। তাদের ঘুরিয়ে নাম কর্তে বাধ্য করান। যেমন কোন গ্রামে ভক্তগণ নাম করে, তামসিক প্রকৃতির লোকের নিদ্রার ব্যাঘাত না হলে’ও বলে, ‘‘বেটাদের নামের জ্বালায় গেলুম।’’ নাম এইভাবে তা’র জিহ্বায় নৃত্য কর্তে থাকেন। ক্রমে নাম তাকে আত্মসাৎ করে নেন।
দেখতে পাই, নামের হুজুগে প্রথমে ছেলে-বুড়ো অনেক লোক মাতে। কিছুদিন পরে অর্থাৎ এক, দুই, বড় জোর তিন বৎসর সেই মাতনী থাকে। তারপর যে কে সেই। একি ব্যাপার?
নাম যদি কৃপা কর্লেন, তা’হলে আবার তারা সেই নাম ছেড়ে সংসারে মাতে কি করে?
জগৎটাই পরিবর্ত্তনশীল। কোন মহাপুরুষের কৃপায় হয়তো ছেলে বুড়ো সকলে কিছুদিন নামকীর্ত্তন কর্লে। আবার চাকা ঘুরে গেলো। নাম থেকে তা’রা দূরে চলে গেলো। তার মধ্যে সুকৃতি সম্পন্ন ভক্ত হয়তো ২/৪ জন নাম ছাড়তে পারলেন না। প্রকৃতি সেখানে আপনার পরাক্রম দেখাতে সমর্থ হলেন না। একবার শরণাগত হতে পার্লে, আর নাম ছাড়াবার শক্তি প্রকৃতির থাকে না।
আচ্ছা যারা কিছুদিন খুব নাম করে, নাম ছেড়ে দিলে তাদের পূর্ব্বকৃত সমস্ত নাম কি নষ্ট হয়ে গেল?
না, না, একটি নাম নষ্ট হয় না! যে কয়টি নাম মানুষ শুনে, যে কয়টি নাম মানুষ উচ্চারণ করে, সবগুলি তা’র রক্তে, মাংসে, অস্থি, মজ্জায় মিশে যায়, শরীরের অণু-পরমাণুতে নাম মিশে থাকে। আবার যখন সুকৃতির উদয় হয়, তখন নাম করতে করতে নামের পুঁজী বাড়াতে থাকে।
তা’হলে নামকারীর কৃত নাম নষ্ট হয় না, তার দেহে সঞ্চিত থাকে?
হ্যাঁ! যেমন কুপে ইঁট ফেল্লে ইঁট আর ফিরে আসে না, তদ্রূপ নাম শুন্লে বল্লে, সে নাম তা’র রক্তে মাংসে মিশে থাকে।
আচ্ছা হয়তো কোন নামকারী দুশ্চরিত্র মদ্যপ হ’য়ে গেলো। তা’র পূর্ব্বকৃত নাম কি নষ্ট হয়ে যাবে?
না, না, সে নাম সঞ্চিত থাক্বে। সেই মদ ও নারীর পদাঘাতে যেদিন তা’র চৈতন্য হবে, সেদিন আবার তা’র পূর্ব্ব সঞ্চিত নামের ভান্ডার দৃষ্টি-গোচর হবে। আবার সে নামানন্দে বিভোর হয়ে নৃত্য কর্বে।
আচ্ছা নামের শরণ নিয়েও লোকের পতন হয় কেন?
পতনের মূল কারণ দুষ্ট প্রারব্ধ। প্রারব্ধ তা’কে ফেলে দিলেও নাম তা’কে তুলে নেন। তবে সাধুগণের স্ত্রী সম্বন্ধে খুব সাবধান থাকা কর্ত্তব্য। নচেৎ উন্নতির পথে উঠা কঠিন। সাধুরা বলেন কাজলের কুঠুরীতে বাস কর্লে, কিছু না কিছু কালি লাগে। তদ্রূপ স্ত্রীসঙ্গেও চিত্তে কিছু না কিছু দাগ লাগে। যা’রা আন্তরিক আনন্দেরপ্রার্থী, তাদের অবশ্য-তর্ত্তব্য হ’ল কায়মনবাক্যে স্ত্রী-সঙ্গ ত্যাগ।
স্ত্রী-শূন্য স্থান তো জগতে নাই! তাহ’লে মানুষ যাবে কোথায়?
স্ত্রীসঙ্গ-ত্যাগ অর্থে মেলামেশি না করা – দূরে দূরে থাকা।
আর কোন উপায় আছে?
হ্যাঁ, কেবল নাম করা। জিহ্বার বিরাম না দেওয়া। সর্ব্বদা যে নাম করে তা’কে ফেলবার সাধ্য কারও নাই।
কেবল – রাম রাম রাম রাম।