নাবার জল

শ্রীশ্রীঠাকুর || প্রকাশ কাল - April 18 2018

ক্ষেপা কুটীরে বসে ‘‘সীতারাম বেশ নাবার জল, বেশ নাবার জল’’ ব’লে হাততালি দিচ্ছে, এমন সময় হলধর এসে বললে – ‘ও ক্ষেপা বাবা, তুমি কি আজকাল তোলা জলে নাইছ না কি? কৈ নাবার জল?’
ক্ষেপা সীতারা – এ জল দেখা যায় না, ঝর ঝর করে হরির পা থেকে মাথায় পড়ে ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে শরীরের ভিতর ঢুকে সব মলয়া-মাটী ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়। সীতারাম সীতারাম!
হলধর। ও জলে নাইলে বাহিরের ও ভিতরের ময়লা যায় ত?
ক্ষেপা। নিশ্চয়ই যায়।
অলিনীলঘ – নশ্যামং নলিনায়ত-লোচনম্‌।
স্মরামি সচ্চিদানন্দং তেন স্নাতো ভবাম্যহম্‌।।
হলধর। এর মানে কি?
ক্ষেপা। ভ্রমরের মত ঘন শ্যামবর্ণ, আয়তলোচন, নিতেজ্ঞান, আনন্দময়কে স্মরণ করছি – তাঁর দ্বারা স্নাত হচ্ছি।
হলধর। ভাল করে বুঝেয়ে বল।
ক্ষেপা। অস্তি, ভাতি, প্রিয়, তাঁর স্বরূপ-লক্ষ্মণ; সেই অনাম, অরূপ পুরুষের নীলবর্ণ আকাশই আয়ত লোচন, তিনি অনিমেষে আমার দিকে চেয়ে আছেন, তাতে আমি স্নাত হচ্ছি। আহা! আহা! (ক্ষেপার শরীর রোমাঞ্চিত, নয়নে জলধারা)
কিছুক্ষণ পরে হলধর বলিল – ও ক্ষেপা বাবা, তুমি বললে তোমার নাবার জল দেখা যায় না, কিন্তু ঐ যে তোমার নাবার জল চোখ দিয়ে গড়িয়ে বুক ভাসিয়ে দিয়েছে।
ক্ষেপা। সীতারাম – সীতারাম!
হলধর। আচ্ছা, ভিতরের – বাহিরের মল কি?
ক্ষেপা। পঞ্চীকৃত পঞ্চভূতগঠিত স্থুল দেহ বাহিরের মল; পঞ্চ প্রাণ, মন, বুদ্ধি দশ ইন্দ্রিয় সমন্বিত সূক্ষ্ম দেহ ও অজ্ঞানরূপ কারণ-দেহ ভিতরের মল – ধুয়ে ফেলতে হয়।
হলধর। ধুয়ে ফেলার পর কি করতে হয়?
ক্ষেপা। অচ্যুতোহহমনন্তোহমানন্দোহহং হরিঃ।
নিত্যোহহং নির্ব্বিকল্পোহহং নিরাকারোহস্ম্যহং সদা।
সচ্চিদানন্দরূপোহহমজোহহম-মৃতোহস্ম্যহং।
ব্রক্ষৈবাহং ন সংসারী মুক্তোহহমিতি ভাবয়েৎ।
হলধর। ভেঙ্গে বল।
ক্ষেপা। অচ্যুত অর্থাৎ আমি সর্ব্বদা একরূপ, আমি সীমাশূন্য, আমি আনন্দ, আমি নিত্য, ক্ষয়োদয়রহিত, আমি একমাত্র, আমার বিকল্প নাই, আমি নিরাকার, আমি নিত্য জ্ঞান-আনন্দ রূপ, (নামরূপ আমার নাই) আমি অজ, আমি চির সমুৎপন্ন, আমি অমৃত, আমি ব্রহ্ম, পুনঃ পুনঃ আগমনকারী জীব নই। আমি নিত্য মুক্ত, ইহা ভাবনা করতে হয়।
হলধর। এ কথা ভাবনা করা কি সহজ? রাম নাম করতে বললে না হয় জিহ্বা আছে রাম নাম ক’রে গেলাম। কিন্তু এ ভাবতে পারব না।
ক্ষেপা। আরে আমার ঠাকুর বলেছেন – অশুক্লুবন্‌ ভায়িতুৎ বাক্যমেতদুদীরয়েৎ।
সংবৎসরকৃতাভ্যাসান্মুক্তিরেব ন সংশয়ঃ।।
যদি ভাবনা করতে না পার তাহ’লে এই কথা উচ্চারণ করবে। সংবৎসর অভ্যাস করলে নিশ্চয়ই মুক্ত হ’য়ে যাবে।
হলধর। বুঝলাম না, এ কথাগুলি উচ্চারণ করলে কেমন ক’রে মুক্ত হ’তে পারি?
ক্ষেপা। ভিতরে একটা ঊর্দ্ধমুখ স্রোত চলেছে, এ কথাগুলি আনন্দ শক্তি-সম্পন্ন – এগুলি বইতে বইতে প্রাণ বেচারা যেন কেমন হতভম্ব হ’য়ে যায়। ‘অভেদ্য নামনামিনোঃ’ কি না – আনন্ত কোটী ব্রহ্মান্ড যাঁর এক পাদে প্রকাশিত, তিন পাদের সন্ধান নাই, এ সব ত তাঁরই নাম গো। প্রাণ কেমন হয়ে গিয়ে একেবারে স্রোতে গিয়ে পড়ে যায় – যেমনি পতন অম্নি ডোবন। জয় সীতারাম – জয় সীতারাম।
প্রত্যন্মুখত্বাৎ প্রবিশন্‌ সুষুম্নাং সমাগমৌ মুঞ্চতি গন্ধবাহঃ।
হলধর। কোথায় ডোবে?
ক্ষেপা। ত্রকূট নাম্ন তিমিরান্তরেখে স্তম্ভং গতে কেবলং কুম্ভ এব।
প্রাণানিলো ভানুশশাঙ্কনাভ্যৌ
বিহায় সদ্যো বিলয়ং প্রযাতি।।
যোগতারাবলী।।
মানুষের হৃদয় মধ্যে ত্রিকূট নামে একটী শূন্য স্থান আছে। প্রাণ-বায়ু সেই স্থানে স্তব্ধীভূত হ’লে কেবল কুম্ভক হয়, ইড়া-পিঙ্গলা ত্যাগ ক’রে প্রাণবায়ু সদ্যো বিলয় হ’য়ে যায়, তারপর – ‘বিলীয়তে বিষ্ণুপদে মনো ম’। বুঝলে সীতারাম কি ক’রে মুক্তি হয়?
হলধর। এ যে উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে হ’ল, যোগতারাবলীতে আছে উড্ডীয়ান, জালন্ধর, মূলবন্ধ – এ তিনটির অনু্ষ্ঠান করল সর্পবৎ কুলকুন্ডলিনী নিদ্রা ত্যাগ ক’রে জাগরিত হ’লে, প্রাণবায়ু অধোমুখে, সুষুম্নামার্গে প্রবেশ করে। আর তুমি এ কি বলছ?
ক্ষেপা। ওই আাঁটকুড়ীর বেটী সর্ব্বঘাটে কাঁটালি কলা, শুধু যে বন্ধের অভ্যাস করলেই পাওয়া যায় তা’নয়। মন্ত্রযোগে মূর্ত্তির মধ্যে ইনি আছেন। লয়যোগে জ্যোতির মধ্যেও ওঁর আড্ডা, রাম রাম করলেও জাগেন, গায়ত্রী জপ করলেও জাগেন, মা ওমা, জাগ মা – জাগ মা – বলে বালকের মত কাঁদতে পারলেও জাগেন। বেটী জাগলেই ব্যস, কেল্লা ফতে। সীতারাম সীতারাম – ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান।
হলধর। কিন্তু একটা ভয়ানক কথা হচ্ছে, ক্ষুদ্র কীটানুকীট আমি কোথায়, আর কোথায় অনন্ত ঐশ্বর্য্যশালী শ্রীভগবান্‌।
মায়াবাদমতান্ধকারমূষিত প্রাজ্ঞোহসি যস্মদহম্‌।
ব্রহ্মাস্মীতি বচো মুহুর্মুহুর্বদাসিরে জীবস্ত্ববমু্ন্মত্তবৎ।
ঐশ্বর্য্য তব কুত্র কুত্র বিভূতা সর্ব্বজ্ঞাতা কুত্র তে
তন্মোরোরিব সর্ষপেন হি ভিদা জীবত্বয়া ব্রহ্মণঃ।।
আমার ঐশ্বর্য্য কোথায়? বিভূতা কোথায়? সর্ব্বজ্ঞতা কোথায়? তবু যদি আমি ব্রহ্মাস্মি বলি তাহ’লে কি পাগলের কথা হয় না? তিনি সূর্য্য – আমি রশ্মি, তিনি সমুদ্র – আমি তরঙ্গ; তাঁতে আমাতে কত তফাৎ।
ক্ষেপা। সূর্য্যরশ্মি কি সূর্য্য নয়? তরঙ্গ কি সমুদ্র নয়? রশ্মি ও তরঙ্গ কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় যাবে?
হলধর। রশ্মি সূর্য্য হ’তে এসেছে, সূর্য্যে লয় হবে। তরঙ্গ সাগরের বুকে ভেসেছে, সাগরের বুকে মিশে যাবে।
ক্ষেপা। তাহ’লে তরঙ্গ যদি মনে করে আমি সমুদ্র, তাতে কি ক্ষতি হ’তে পারে? এ ছাড়া পথ কোথায়? যখন চিত্ত তার উৎপত্তি স্থলে ফিরে যায় তখন সে তন্ময় হ’য়ে যাবে মহাভক্তনারদ বলেছিলেন –
প্রেমাতিভর – নিভিন্নঃ পুলকাঙ্গো-ইতিনিবৃতঃ।
আনন্দসংপ্লবে লীনো নাপশ্যমুভয়ং মুনে।।
-শ্রীমদ্ভাগবত
উভয়ং – আত্মানং পরঞ্চ – শ্রীধর স্বামী। রাসমন্ডল হতে ঠাকুরটী অন্তর্হিত হ’লে গোপিকাগণ তাঁকে অনুসন্ধান করতে করতে তাঁর চিন্তায় তন্ময়তা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, কেহ বলেছিলেন – ‘কৃষ্ণোহহং পশ্যতে গতিং’, কেহ বললেন – ‘মা ভৈষ্ট বাত বর্ষাভ্যাম্‌’, কেহ বা বললেন – ‘দুষ্টাহে গচ্ছ জাতোহহং খলানাং ননু দন্ডধৃক’। আমি কৃষ্ণ – এ ভাবে তাঁদের এসেছিল। ভগবচ্চিন্তায় প্রহ্লাদের অবস্থা – বিসম্নার তথাত্মানং নান্যৎ কিঞ্চিদজানত।
অহমেবাব্য-য়োহনন্তঃ পরমাত্মে-ত্যাচিন্তয়ৎ।।
প্রহ্লাদ আপনাকে ভুললেন – আর কিছু জানতে পারলেন না; আমি অব্যয়, অনন্ত, পরমাত্মা – ইহা চিন্তা করেছিলেন। এ সব জ্ঞানীর কথা বলছি না, ভক্তের কথাই বলছি। চিত্ত – যা গ্রহণ করবে তাই হয়ে যাবে। মারীচ রামচন্দ্রের শয়রাঘাতে সাগরে পড়ে সর্ব্বত্র রামকে দেখতে – ‘রামদেব সততং বিভাবয়ে’।
কংসের অবস্থা তাই হয়েছিল – আসীনঃ সংবিশং তিষ্ঠান ভুঞ্জান পর্য্যটন্‌ মহী।
চিন্তয়ানো হৃষীকেশমপশ্যৎ তন্ময়ং জগৎ।।
ব’সে, দাঁড়িয়ে, ভ্রমণ করতে করতে সর্ব্বদা হৃষীকেশকে চিন্তা ক’রে কংস জগৎই কৃষ্ণময় দেখত।
শিশুপালও দ্বষ ক’রে তন্ময়তা প্রাপ্ত হয়েছিল। মারীচ, কংস, শিশুপাল প্রভৃতি অসুরগণ ভক্ত নয় বলে সর্ব্বত্র শ্রীভগবানকে দেখেছে কিন্তু ‘আমিই সেই’ – এই জ্ঞান হয় নাই।
শাল্ব বাসুদেবকে ভাবতে ভাবতে চতুর্ভুজধারী হ’য়ে গিয়েছিল। পুজা করতে যাও – ‘দেবো ভূত্বা দেবং যজেৎ’।
তান্ত্রিক সাধনায় ভূতশুদ্ধি প্রভৃতিতে সর্ব্বত্র ‘সোহহং’ কথা। যে কোন সাধনা করতে যাও ‘তুমি জড় দেহ নও, তুমি চৈতন্য, – ইহা স্মরণ করতেই হবে। তুমি খন্ড না হয়েও যে খন্ড হয়ে আছ এর জন্যই ত সাধনা, না আর কিছু? তুমি পাশবদ্ধ হয়ে আছ তাই জীব, তোমার চরম লক্ষ্য ত সেই শিবত্ব প্রাপ্তি।
হলধর। আমি শিব হ’তে চাই না – শিবকেই চাই। আমি শিবের দাস।
ক্ষেপা। ‘‘দাসোহহং’’ ‘‘দাসোহহং’’ – করতে করতে যখন ঠাকরটীর কৃপা দৃষ্টি পড়ে তখন ঠাকুর ‘‘দা’টী কেড়ে নেন, থাকে ‘‘সোহহং’’। তবে সংসারলুব্ধ, তপস্যাশূন্য, ভক্তিহীন – তাদের ‘‘সোহহং’’ ‘‘ব্রহ্মাস্মি’’ ওটা বকবাদ মাত্র। পরোক্ষ জ্ঞান অর্জ্জন করে তা যদি অপরোক্ষ করবার চেষ্টা করা না হয় – তার কোনই উপকার নেই।
হলধর। দেখ, আমি জ্ঞানের কথা বুঝতে পারি না, বেশ তাতে আনন্দও হয় না।
ক্ষেপা। কাজ কি তোমার জ্ঞানে? তুমি তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ কর। শরণাগত হও। তাঁর যা খুসী তাই করুন। সীতারাম।
হলধর। করব কি, এক বৎসর যথানিয়ম মানস স্নানের মন্ত্র ত দূরের কথা, এক মাস ঠিক হবে কি না তাই সন্দেহ। কত বাধা যে ভোগ করতে হয় তার ঠিক নাই। রোগ আছে, শোক আছে, দারিদ্র্য আছে। একটী বেশ সরল, সহজ পথ বলে দাও দেখি, সেইটী ধরেই প্রাণপণ করি।
ক্ষেপা। দীক্ষা হ’য়ে গেছে ত?
হলধর। হ্যাঁ।
ক্ষেপা। মন্ত্রটী অবলম্বন কর, মন যখন চঞ্চল হবে তখন চেঁচিয়ে নাম কর – শান্ত হ’লে মন্ত্র জপ কর। তারপর লীলাচিন্তা কর। নাম ও লীলাচিন্তাই এ যুগে লঘূপায়, – আমার ঠাকুর এ কথা উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করেছেন।
হলধর। কেবল রাম নাম করলে একেবারে শেষ ঠিকানায় পৌছে দেবে ত?
ক্ষেপা। জপতঃ সর্ব্ববেদাংশ্চ সর্ব্বমন্ত্রাংশ্চ পার্ব্বতি।
তস্মাৎ কোটি গুণং পুণ্যং রামনাম্নৈব সকৃৎ লভ্যতে।।
প্রাণপ্রয়াণসময়ে রামনাম সকৃৎ স্মরেৎ।
স ভিত্বা মন্ডলং ভানোঃ পরং ধামাভিগচ্ছতি।।
হে পর্ব্বতি! সমস্ত বেদমন্ত্র জপ করলে যে ফল লাভ হয়, তাহা হ’তে কোটীগুণ পুণ্য রামনামের দ্বারা লাভ হয়। প্রাণ-প্রয়াণ সময়ে, যে একবার রামনাম করে, সে সূর্য্যমন্ডল ভেদ ক’রে পরম ধামে গমন করে – বুঝলে? জয় সীতারাম – জয় সীতারাম।
হলধর। শ্রীরাম রাম রাম সীতারাম সীতারাম।
ক্ষেপা। জপ করতে করতে তন্ময়ত্ব আসে। ডাকতে ডাকতে রূপ ধ’রে ঠাকুর যখন অলক্ষিতে এসে আলিঙ্গন দেন – অশ্রু পুলক কম্প উপস্থিত হয়, ভক্তের তখন কি এক অপূর্ব্ব অবস্থা হয়, ভক্ত তাতেই ডুবে যায় গো, সে যে কোমল হ’য়ে যায়, আপনাকে হারিয়ে ফেলে, তখন কে তার পৃথকত্ব বজায় রাখবে, নেশা কাটলে ভক্ত ভক্ত হয়। আমার প্রেমের ঠাকুর শ্রীমন্মহাপ্রভু কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপ করতে করতে ‘মুই সেই, মুই সেই’ ব’লে উঠতেন। আমার শ্রীমতী রাধার কথা বিদ্যাপতি বলেছেন –
অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে সুন্দরী ভেলি মাধাই।
ও নিজ ভাব স্বভাব হি বিছুরল আপন গুণ লুবধাই।
মাধব অপরূপ তোহারি সুনেহ
আপন বিরহ আপন তনু জর-জর
জীবইতে ভেল সন্দেহ।।
ভোরহি সহচরি কাতর দিঠি হেরি
ছলছল লোচন পাশি।
অনুখন রাধা রাধা রটতঁহি
আধ আধ কহু বাণী।
ক্রমশঃ —–