সীতারাম সাধুসন্তের জন্য আসে নাই

কিঙ্কর শঙ্করনাথ || প্রকাশ কাল - March 6 2018


ঠাকুর মুখ হাত ধুয়ে যে কয়টি দীক্ষার্থী বাকী ছিল তাহাদিগকে দীক্ষা দিয়ে গাড়ি করে বের হয়ে পড়িলেন আসানসোল জেলখানা পরিদর্শন করিতে। সেখানে ৮জন কয়েদীকে দীক্ষা দান করিলেন। প্রসাদ পেয়েই জেলখানায় গেলাম তখন জেলের সমস্ত কয়েদীরা ঠাকুরকে ঘরে নাম করছে। ঠাকুর মাঝখানে নেচে নেচে করতাল বাজাচ্ছেন আর কয়েদীরা দুর্দ্দান্ত নৃত্যসহ ঘুরে ঘুরে নাম করছে সে এক অভিনব দৃশ্য। জেল্যর নাম করা পাপীর দল আজ কিসের আকর্ষণে সমস্ত পাপ প্রবৃত্তি মন হইতে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ভগবানের নামে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। স্পর্শমণির স্পর্শে মুহূর্তের জন্য সব লৌহ যেন স্বর্ণে পরিণত হয়েছে। সাধু কৃপা সদ্য ফলদান করে পাত্রা-পাত্রের বিচার করেন না দেশ কালের অপেক্ষা করেন না। আসানসোল জেন ধন্য, জেলের কয়েদীর দল মহাসৌভাগ্যবান যে অযাচিত ভাবে মহাপুরুষের স্পর্শন দর্শন কৃপালাভ করিতে পারিল।
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি ওই ৪টি যুগের মধ্যে কোন গ্রন্থে বা ইতিহাসে পাই নাই বা শুনি নাই যে কোন মহাপুরুষ প্রকাশ্যভাবে কারাগারের ভিতর ঢুকে পাপী, মহাপাপী কয়েদীদের এরূপভাবে কৃপা করেছেন। ঠাকুর আমার কৃপার সাগর পাপীর জন্য যেন উথলিয়ে উঠেছেন। খুঁজে খুঁজে পাপী উদ্ধার করছেন বাহিরের পাপী-তাপী উদ্ধার করে তৃপ্তি হচ্ছে না তাই যেখানে পাপীর হাট, জেলখানা, সেখানে ঢুকে উদ্ধার যজ্ঞ চালাচ্ছেন। একদিন এক মাতাল দীক্ষা নিতে উপস্থিত হয়েছে বেশ মাতলামীও করছে, বলছে ‘‘আমায় দী-ক্ষা দে-রে! আ-মি-আ-র-মদ-কা-ব-না’’। এইভাবে মাতলামী করছিল ঠাকুরকে বলিলাম এক মাতাল এসেছে দীক্ষাপ্রার্থী হয়ে – বসাব? ঠাকুর বললেন কোথায় নিয়ে আয়। মাতাল ঠাকুরের কাছে এসেই চরণ ধরে কেঁদে পড়লেন। ঠাকুর চুলের মুঠি ধরে উঠালেন। তখন মাতাল বলছে আ-মি-আ-র-মদ খাব না, তুমি আ-মা-র মদ ছাড়িয়ে দাও। ঠাকুর বললেন – ‘আর মদ খাবে না যাও মন্ত্র দিচ্ছি’। মাতালকে দীক্ষায় বসাতে দ্বিধা সঙ্কোচ করছিলাম ঠাকুর আম্লান বদনে খুশী হয়ে অনুমতি দিলেন এবং বলিলেন, ‘দেখ সীতারাম সাধু সন্তের জন্য আসে নাই, যত চোর ছেঁচর লম্পট খুনি গুন্ডা বদমাস এদের জন্যই সীতারাম এসেছে।’
তিনি যে অধমতারণ পতিতপাবন এতে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিচ্ছেন, অধমের জন্য তাঁর কত দয়া কত কৃপা। কত নাম করা মাতাল এঁর কৃপা পেয়ে মদ ছেড়ে মনুষ্যত্ব লাভ করে ধন্য হয়েছে, সীতারাম হাজার হাজার জগাই মাধাই উদ্ধার করে চলেছেন কে তার হিসাব রাখে।
ঠাকুর জয় দিয়ে নাম বন্ধ করিলে কয়েদীরা হরিরলুট এনে ঠাকুরকে নিবেদন করিলে ঠাকুর চারিদিকে ছড়াইয়া দিলেন। তারপর কয়েদীদের মধ্যে কাকেও জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি বাবা। কি অপরাধ করেছিলে?’
কয়েদীরা যার যার অপরাধ ঠাকুরকে বলিল। ঠাকুর তখন মৃতুঞ্জয় দাদাকে বলিলেন, ‘তোর জেলে খুনী আসামী কত জন আছে?’ এমন সময় একটি কয়েদী সীতারামের শিষ্য বলে পরিচয় দিলে ঠাকুর বলিলেন, ‘কি অপরাধ করেছিলে?’ কয়েদী বলিল, ‘বাবা, বিনা টিকিটে গাড়ীতে বসিয়াছিলাম।’ ঠাকুর বলিলেন, ‘ফাঁকি দেওয়ার ফল ভোগ কর’। এরপর ঠাকুর যে কয়েকজনকে দীক্ষা দিয়াছেন তাহাদের প্রণাম গ্রহণ করলেন। আমি তখন ঠাকুরকে বলিলাম, ‘বাবা এ এক অভিনব ব্যাপার হয়ে গেল। ভারত আর জেলখানা থাকিবে না, সব উঠে যাবে।’ ঠাকুর বললেন, ‘মৃত্যুঞ্জয়কে উপলক্ষ করে ঠাকুরটি অপূর্ব খেলা দেখাচ্ছেন।’ ইহার পর ঠাকুর মৃত্যুঞ্জয়দার কোয়ার্টারে গয়ে ফলভোগ গ্রহণ করে নীচে নেমে আসতে বহুলোক প্রণামের জন্য অনুরোধ করে।
মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী আসানসোলের জেলার, রাণীগঞ্জের প্রফেসার সদানন্দ চক্রবর্তীর সহোদর, ঠাকুরের বিশেষ প্রিয় ও ভক্ত সন্তান খুব অমায়িক ইহারই আহ্বানে ঠাকুর জেলখানায় এসেছেন। প্রণাম গ্রহণ করে আরো ২/৪ টি ভক্ত শিষ্যের প্রার্থনায় তাদের বাড়ীতে চরণধুলি দিয়ে সন্ধ্যার সময় সত্যকালীদার বাড়ীতে ফিরে এসে বিশ্রাম নিলেন। আজ ঠাকুরের শ্রীতনুর অবস্থা ভাল নাই, বড্ড ক্লান্ত ও অসুস্থ বোধ করিতেছেন তথাপি কর্ম্মসূচী বজায় রাখার জন্য ১ ঘন্টা বিশ্রামের পরই উঠে বসিলেন। বাহিরে ভাষণ শোনার জন্য প্রচুর জনতার সমাবেশ হয়েছে। ২/৩ ঘন্টা ধরে তারা অপেক্ষা করছে। ঠাকুর ভাষণ আরম্ভ করিলেন। ভাষণ দিতে দিতে শেষে সমাধিস্থ হলেন। সমাধি ভাঙ্গার পর ঠাকুর সবার প্রণাম গ্রহণ করিলেন এমন সময় বার্ণপুর হইতে এসে শ্যামানন্দদা (বার্ণপুর এষ্টেটের ম্যানেজার) ৫/৬ খানা গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করেছেন ঠাকুরসহ আমাদের নিয়ে যাবার জন্য। আগামীকাল বার্ণপুরে শ্যামানন্দদার বাংলোতে ঠাকুরের প্রোগ্রাম হয়েছ রাত্রেই আমাদের নিতে এসেছেন, কিন্তু ঠাকুর অসুস্থ বোধ করায় রাত্রে আর বের হলেন না। বললেন, ‘তোরা সব চলে যা সীরারাম পরে যাবে।’ আমরা রাত্রে বার্ণপুরে চলে গেলাম। ঠাকুর রাত্রে না আসায় গঙ্গাদা সচ্চিদানন্দদা ফিরে আসানসোলে গেল ঠাকুরের সংবাদ নিতে, আমরা ভোরে উঠে যাথারীতি কাজে লেগে গেলাম। গঙ্গাদা ঘুরে এসে সংবাদ দিলেন, ঠাকুর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ১০৫ ডিগ্রি জ্বর, আসতে পারবেন না। রাণীগঞ্জে ডাক্তার লালমোহনদার বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হইবে ও সেখানে চিকিৎসা হবে। আমার ও হরিসাধনের উপর বার্ণপুর উৎসব রক্ষা ও পরিচালনার ভার দিয়াছেন ও সঙ্গী ছেলেদের মধ্যে কেহ যেন ফিরে চলে না আসে বলে দিয়েছেন। ঠাকুর না আসায় সকলেরই মনটা খারাপ হয়ে গেল বিশেষ করে শ্যামানন্দদার। তাকে বুঝিয়ে বলিলাম, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য, আপনি কোন দুঃখ করিবেন না। এক দীক্ষা ছাড়া আপনার উৎসবে সব কিছুই হবে, কোন চিন্তা করবেন না। শ্যামানন্দদা প্রচুর আয়োজন করেছেন আমরা ভোর হইতে অখন্ড নাম চালিয়েছি পূজাপাঠ ভোগ রান্না প্রভৃতি যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হইলে নরনারায়ণ –এর সেবাদি কার্য্য নির্ব্বিঘ্নে শেষ হল। রাত্রে ঘুম না আসায় ঠাকুরের কথাই চিন্তা করিতে ছিলাম উৎসবে ঠাকুর উপস্থিত না থাকায় সবই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কোন আনন্দ বা উৎসব ছিল না যদিও উৎসবে কর্ম্মকান্ডের দিকে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি হয় নাই। তবু যেন মনে হল প্রাণহীন উৎসব শিবহীন যজ্ঞ। হঠাৎ অসুস্থতা অধিক পাপ গ্রহণের প্রমাণ। গতকল্য জেলখানায় কয়েদীদের উদ্ধারের নিদর্শন এই ১০৫ ডিগ্রি জ্বর। দিবারাত্র কত পাপ যে টেনে নিচ্ছেন তার হিসাব নেই। কাহার রোগ টেনে নিচ্ছেন কাহার শোক, কাহার তাপ, কাহার জ্বালা যন্ত্রণা কাহার অতি পাপ মহাপাপ। ১৩৬৪ সালে আমি যখন লিভার ক্যানসারে ভুগিতেছিলাম সেই সময় ঠাকুর অলৌকিক ভাবেই আমাকে রক্ষা করে ছিলেন। (ইহা ‘জয় গুরু’ পত্রিকায় ১৯শ বর্ষ ১৬ সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছে। ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৩৬৪ সাল। ঠাকুর রাত্রে ১০৫ ডিগ্রি জ্বরে কাতর হয়ে শুয়ে আছেন। সেই সময় আমার বড় শালী শ্রীমতী বাসন্তী দেবী ঠাকুরের চরণে ঘি মালিশ করতে করতে দেখতে পায় যে তাহার ডান চরণের তলে একটি দগদগে ঘা হয়ে আছে সে অতি সন্তর্পণে মালিশ করে এসে তার বড়দিকে বলে কন্তু কি আশ্চর্য্য পরের দিন তার চিহ্নমাত্র নাই। যখন বোঝা বেশী হয়ে যায় তখন নিজে ভুগে বোঝা হাল্কা করেন আর তা নাহলে সঙ্গে সঙ্গেই হজম করে ফেলেন। কর্ম্মফল জীব মাত্রই ভোগ করতে হয় ইহা হইতে কেহই রেহাই পায় না দেহ ধারণ হয়েছে শুধু কর্ম্মফল ভোগ করার জন্যে যার যেমন কর্ম্মফল শেষ হয়ে যাচ্ছে সে তখন চলে যাচ্ছে, সেই কর্ম্মের পরিপাক কালে নানা রকম ভাবনা যন্ত্রণা আপদ বিপদের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে শেষ পর্য্যন্ত বাধ্য হয়ে ভগবানের শরণাপন্ন হয়। তাই ঠাকুর তাঁর শরণাপন্ন সন্তানের কাতর ডাকে স্থির থাকতে পারেন না, আমার রোগ জ্বালা যন্ত্রণা বিপদ লিভার ক্যানসার নিজে টেনে নিয়ে একরাত্রি ভোগ করে কাটিয়ে দিলেন এবং আমাকেও রক্ষা করিলেন। যে রোগে শতকরা ৯৯ জন বাঁচে না। ঠাকুর সেই অসুখের সময় আমাকে বলে ছিলেন, ‘তোর রোগা মঠে এসে সীতারামও রোগা হয়ে গেল’ – আমি বলেছিলাম ‘তা হবেনা আমাকে কেমন ভোগাচ্ছ এবার নিজেও একটু ভোগ’। ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তা ত ভুগছিই’। এখন সেই সব কথা মনে হলে প্রাণে খুব ব্যথা পাই। আমি আমার কর্ম্মফল ভোগ করিব সেখানে আমার প্রাণের প্রাণ ঠাকুরকে কষ্ট দেব কেন? তার চাইতে রোগ ভোগ করে মরে যাওয়াই ভাল ছিল।
পরের দিন ১৩ই অগ্রহায়ণ ভোরে উঠে অসুস্থ ঠাকুরকে দেখতে আমরা সব বাসে করে রাণীগঞ্জে গেলাম। যাইয়া দেখি ঠাকুর একটু সুস্থ আছেন। সমস্ত প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে গেছে এখন ঠাকুর কিছুদিন বিশ্রামে থাকিবেন। সঙ্গী ছেলেদের গন্তব্য স্থানে বিদায় দিলেন।
রাণীগঞ্জ অসুস্থতার পর শ্রীঠাকুর সুস্থ হয়ে আবার প্রচারে বের হলে, প্রচারে সঙ্গী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়া ১১ই মাঘ ৬৬ কলিকাতা পার্ক সার্কাসে সঙ্গ নিলাম। এখান হইতে ১২ই পায়রাগাছা (জনাই) হয়ে ১৩/১৪ই দুদিন বোলপুরে, ঠাকুরকে পেয়ে সবাই কৃতার্থ, আনন্দে আত্মহারা। এখানে বহু দীক্ষা হল এবং লোকের ভীড়ও প্রচুর। ১৫ই আলিগ্রাম হয়ে ১৬ই মুকশিম পাড়া, ১৭ই কাঁথির পথে ১৮/১৯/২০ তিন দিন কাঁথি, ২১শে মেদিনীপুর, ২২শে কোতলপুর, ২৩শে কারকবেড়ে, ২৪শে রঘুবাটী, ২৫শে আরামবাগ, ২৬শে উড়ো, ২৭শে বর্দ্ধমান ও ২৮শে মাঘ তারিঘাট যাত্রা করিলেন। শ্রীঠাকুর তারিঘাট যাওয়ার পূর্ব্বে বলে গেলেন একবার বহরমপুর (গঞ্জাম) যাওয়ার জন্য সেখানে দেখাশুনার লোকের অভাবে খুব অসুবিধা হচ্ছে। বহরমপুরে পত্র লিখে উত্তরে জানিলাম এখন সব ঠিক হয়ে গেছে আর যাওয়ার কোন প্রয়োজন হবে না। ঠাকুর তারিঘাটে মৌনে বসিবেন। উক্ত সংবাদ পাওয়া মাত্র ঠকুরকে জানালে উত্তর লিখিলেন –
মহাপ্রয়ান মঠ তারিঘাট পোঃ গাঞ্জিপুর
১২/১১/৬৬
প্রেমভাজনেষু –
বাবা শঙ্কর তোর পত্রে বিবৃত অবগত হলাম। তোরা ঠাকুরের আশীর্ব্বাদ জানবি জানাবি। আশা করি ভাল আছিস। বহরমপুরে যেত হলো না ভালই হলো। যে ভাবে নামপ্রচার করছিলি সেভাবেই নাম প্রচার কর, নিত্য ত্রিসন্ধ্যা ও সহস্র গায়ত্রী জপ করবি ছেলেরা যাতে ত্রিসন্ধ্যা করে ও জপ করে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবি মেমারীর ছেলেদের ঠাকুরের আশীর্ব্বাদ দিবি। উপস্থিত এই শেষ পত্র। মঙ্গল
নামরূপে অবতীর্ণ স্বয়ং ভগবান।
নামগানে নামদানে সঁপ মন প্রাণ।।
তোর – সীতারাম
শ্রীঠাকুরের পত্র পাওয়ার পর প্রচারে বের হলাম। বটকৃষ্ণ পাল চাষী গৃহস্থ প্রতি বৎসর তার বাড়ীতে নাম হইত। একবার ইন্‌ছুড়া শ্রীপঞ্চানন দাঁয়ের বাড়ী বলিলেন তার বাড়ীতে নাম যজ্ঞ করাতে, তার বিনয় নম্র কথা শুনে বলিলাম আপনি ত সীতারামের শিষ্য নন আমাদের জয়গুরু সম্প্রদায়ের মত নয়। আপনি কি তাতে রাজি হবেন। তিনি বলিলেন, আপনি যে রূপ করিবেন সেইরূপই হবে। বলিলাম, যদি আপনার গাঁয়ের লোকের আপত্তি হয়, বলিলেন আমি শুনব না। আমার নির্দ্দেশ মত নামে যজ্ঞের ব্যবস্থা হল মঞ্চের সন্মুখে সীতারামের ফটো আমাদের শ্রীশ্রীঠাকুরের ফটো দেওয়া হয়েছে অন্য দিকে অন্যান্য দেব দেবীর ফটো রাখা হয়েছে। গ্রামের অনেক লোক এসেছে অধিবাস দেখতে ব্রাক্ষ্মনের দলও এসেছে এবং আমাকে নানা প্রশ্ন করছেন। আমি যথাযথ উত্তর দিয়ে যেইমাত্র অধিবাসে বসতে যাব এমন সময় ঐ গ্রামের মোড়ল বৃদ্ধ পন্ডিত ঘোষাল মহাশয় একটি লাঠি ভর দিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। ইনি একজন বড় পন্ডিত ব্রাক্ষ্মণ জ্যোতির্ব্বিদ গ্রামের মাতব্বর। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখে ক্রোধভরে উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘এটা কি হরিবাসর হচ্ছে না ওঙ্কার বাসর হচ্ছে। এসব হচ্ছে কি? তোমরা সব দেখলে কি। আর দেব দেবী তোমাদের চোখে ঠেকল না! ওঙ্কার নাথের ছবি মঞ্চের সামনে দিয়েছ। তোমরা ভেবেছ কি, এটা কি এয়ারকির জায়গা, এটা খেলা পেয়েছ।’ ইত্যাদি খুব উত্তেজিত হয়ে বলিতে লাগিলেন। এই সব শুনে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটি কথাও না বলে ঠাকুরকে মনে মনে স্মরণ করে বলিলাম, ঠাকুর এ কোন পাষন্ডের জায়গায় এলে ফেলেছ। একে তুমি কৃপা কর, কার্য্য নির্বিঘ্নে করিয়ে নাও। ঠাকুরের অবমাননায় মনটা খারাপ হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল এখান হতে পালাই, কিন্তু রাত্রি বেলায় তার কোন উপায় নাই। পন্ডিত মহাশয় পাল মহাশয়কে বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে, যা-তা আরম্ভ করেছ’। পাল মহাশয় বললেন দেখুন আপনারা পন্ডিত লোক, আপনারাই ত বলেন গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর সৎ গুরুই ত জগৎগুরু। সীতারামকে জগতের লোক জগৎ গুরু বলে মানছে তাঁর ফটো যদি সামনে রাখা হয় তবে এমন কি অপরাধ হয়েছে প্রভু?’ ইহাতে পন্ডিত মহাশয় আরো উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে শেখাতে চাও? তোমরা সব ভেবেছ কি? নাঃ আমাদের মত লোকের এখানে আসাই উচিত হয় নাই’। এই কথা বলে ক্রোধে গজগজ করিতে করিতে বাহির হয়ে গেলেন। হাফ্ ছেড়ে বাঁচলাম। ঠাকুরের কৃপায় অধিবাস হয়ে গেল। ভোরে মাইকে প্রার্থনা করে নাম ধরা হইল। স্থানীয় লোকই সারাদিন নাম করিল। বৈকালে ইনছুড়ার গুরুভাই গঙ্গা দাঁও বৈদ্য পুরের মন্মথ বাউরীর দল এল। রাত্রে আরতির পর প্রার্থনা করে ঠাকুরের নাম মাহাত্ম্য, মহারসায়ন প্রভৃতি পাঠ হল। পরের দিন ভোরে নাম শেষ করে ধুলোট বার করা হল। নামকারী ভাইদের বলিলাম অধিবাসের ঘটনা। কাজেই এই গ্রামকে নামে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে হবে। দুর্দ্দান্ত নৃত্য সহ প্রচন্ড নামে ধুলোট চলতে লাগিল। গ্রামের লোক ঘর ছেড়ে বাহিরে এসে দাঁড়াল, কতক নামেও যোগ দিল। যখন ঘোষাল পন্ডিতের বাড়ীর নিকট দিয়া নাম যাচ্ছে তখন ঘোষাল পন্ডিতের বড় ছেলে আহ্বান করে তার বাড়ী নিয়ে গেল। আমি তুলসী মঞ্চে ঠাকুরের ফটো নামিয়ে রেখে করতাল হাতে করে নাম করছি এমন সময় কে যেন পেছন দিক হাতে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে নাচতে আরম্ভ করে দিয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাতেই চম্‌কে উঠিলাম, একি এযে সেই ৮০ বৎসরের বৃদ্ধ গোরা পন্ডিত। অধিবাসের সময় সীতারামকে অবহেলা অশ্রদ্ধা করে নানা কটূক্তি দ্বারা মর্ম্মে আঘাত করেছিল, আজ একি তার অদ্ভুত পরিবর্ত্তন। আমাকে শূন্যে তুলে দুর্দ্দান্ত নৃত্য, মুখে উচ্চৈস্বরে নাম কীর্ত্তন, চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। কোথায় গেল তার পান্ডিত্যের অহংকার, বিদ্যার অহংকার, ধনের অহংকার, জনের অহংকার, মান সম্ভ্রমের অহংকার। সকল অহংকার চুর্ণ হয়ে কাঙ্গার হয়ে নামে উন্মাদ হয়েছে। কতক্ষণ এই অবস্থা চলেছিল বলিতে পারি না। আর স্থির থাকিতে পারি নাই। যখন জ্ঞান হল তখন দেখি পন্ডিত মহাশয় আমাকে তাঁর কোলে মাথা রেখে জলের ধারা দিচ্ছেন একটু সুস্থ হলে আমার মালা, চশমা নিজ হাতে পরিয়ে দিয়ে আমাকে তার ঘরে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে নিয়ে গেলেন বাহিরে জোর নাম চলছিল। আমাকে বললেন, ঐ দেখুন রামকৃষ্ণের ফটো, ঐ দেখুন মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের, ঐ দেখুন বিজয়কৃষ্ণের, ঐ দেখুন বিবেকানন্দের, ঐ দেখুন কেলান্ডারে সীতারামের ছবি। আমি কাহাকেও ঘৃণা বা অবজ্ঞা করি না, আমার এই বেদীতে আমি ইষ্টকেও দর্শন করেছি ইত্যাদি। বুঝিলাম ঠাকুর তাকে কৃপা করেছেন, যার জন্য তার জ্বালা ধরেছে, সারারাত ঘুম হয় নাই। আজ প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা শান্ত হবার চেষ্টা করছে, বলিল আজ আপনি যেতে পারবেন না। আপনার সংগে অনেক কথা আছে। রাত্রে এখানে ঠাকুরের ভোগ দিবে, তারপর বের হয়ে এসে নাম দিয়ে রাস্তর দিকে পরিক্রমার সময় দেখি সেই বৃদ্ধ পন্ডিত মহাশয়ও ধুলোটের বের হয়েছেন। এবং প্রচন্ড রৌদ্রতাপে সারা রাস্তা ধুলোট ঘুরে আসায় তার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই।
শ্রীশ্রীঠাকুর তারিঘাটে কঠোর মৌন নিয়ে বসেছেন ১৩৬৬ মাঘ সংক্রান্তি হইতে। ১২/১১/৬৬ তোমার নিকট ‘উপস্থিত শেষ পত্র’ লিখার পর দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস তারিঘাটের থাকার পর হঠাৎ মৌনাবস্থাতেই ২৭/৩/৬৭ তারিখে ভেটদ্বারকায় যাত্রা করিলেন। সেখানে মৌন চাতুর্ম্মাস্য হবে। মৌন চাতুর্ম্মাস্যের পর মৌন ত্যাগ করলেন ১লা অগ্রহায়ণ ১৩৬৭ সালে। ৫ই অগ্রহায়ণ ভেটদ্বারকা ত্যাগ করে সসঙ্গী পুনা আসছিলেন। তারপর হোসেঙ্গাবাদে ১০ দিন যজ্ঞ হওয়ার পর দেওয়াল উজ্জয়িনী ও ওঙ্কারেশ্বর আরও বহুস্থান হইয়া বর্দ্ধমান সেখান হইতে ১৪ই পৌষ দিগসুই যজ্ঞের জন্য ৩ দিন অবস্থানের পর ১৭ই পৌষ মেমারী হেমাঙ্গিনী মঠে আসিলেন। পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত ছিলাম, ঠাকুর আসার সংগে সংগে কিছু লোক গাড়ীর সামনে দাঁড়ালে ঠাকুর নামলেন না বললেন, ‘মঠাধ্যক্ষকে ডাক’। আমি ভীড় ঠেলে ততক্ষণে এসে পড়েছি সামনে গিয়ে প্রণাম করে ঠাকুরকে ধরে মন্দিরে উঠান হলে মন্দির প্রদক্ষিণ করে ভিতরে শ্যামসুন্দর রাধারাণী দর্শন করে বলেলেন, ‘তোরা স্বামী স্ত্রী ৩ মাস তপস্যা করতে পারবি?’ তোমার কৃপা হলেই হবে। ঠাকুর – ‘প্রথম মাস হিবষ্য, ২য় মাস আনাজ সিদ্ধ, ৩য় মাস দুধ বা ফল দুধ ছানা’। আনাজের মধ্যে কি সিদ্ধ চলবে?’ ঠাকুর – ওল, মান, পটল, মিষ্টি আলু, কাঁচাকলা, মটর ডাল, মুগের ডাল সিদ্ধ। ৩ মাস তপস্যা করার পর তোদের সীতারামের মন্ত্রগ্রাম দান করা হবে ইত্যাদি। বুঝিলাম সীতারাম আর বেশীদিন দীক্ষা দেবেন না, একারণে পূর্ব্ব হইতে তৈরী করছেন। শুনিলাম গুরুপুত্র শ্রীমৎ রঘুনাথদাস সস্ত্রীক ৩ মাস তপস্যা করেছেন। বালীর পদ্মলোচনদা সস্ত্রীক তাদেরও তপস্যা করাইয়াছেন। আমার স্ত্রী কল্যাণী বলিলেন, বাবা তুমি আশীর্ব্বাদ কর যেন তপস্যায় উত্তীর্ণ হইতে পারি। উপস্থিত লোকদের প্রণাম গ্রহণের জন্য বাহিরে আসিলেন। ইহার পর ঠাকুরকে ঘরে নিয়ে আসা হল। চরণ ধুইয়ে পূজা করে ভোগে বসিয়ে দেওয়া হল। রাত্রি অনেক হওয়ায় লোকের ভিড় কমে গেল। আমার শাশুড়ী মাতা ঠাকুরাণী ঠাকুরের জন্য নানা প্রকারের খাবার তৈরী করেছিলেন। তার মধ্যে ক্ষীরের লিচু ঠাকুরের কাছে অতি উপাদেয় হয়েছিল একটি খেয়ে বলছেন, ‘এটি (লিচুটিকে দেখিয়ে) কে তৈরী করেছে?’ কল্যাণী বলিলেন, আমার মা (মাকে দেখাইয়া) ঠাকুর বলিলেন, ‘তাই বল বাঙ্গাল না হলে এমন খাবার কে তৈরী করতে পারবে’ এই বলে ৫/৬টি ক্ষীরের লিচু থালা হইতে সরিয়ে রেখে বলছেন, ‘এ কয়টি দিগসুই পাঠিয়ে দিস’। দিগসুই ঠাকুরের গুরুপীঠ প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়, তাই দেখিতে পাওয়া যায় সর্ব কার্য্যে সর্ব ব্যাপারে আগে দিগসুইয়ের গুরুবাড়ীর সংগে সংযোগ। কয়েক বার দূর দূরান্তর হইতে হঠাৎ আমাদের মঠে আসিলে ভোগ নিবার কথা বলিলে তখন বলেন, ‘সামনে গুরুবাড়ী ফেলে রেখে – তোর এখানে ভোগ নেব?’ একবার ত মেমারী হইতে আনাজ তরকারী বাজার করে সংগে করে দিগসুই নিয়ে যান, হঠাৎ গেলে সেখানে তাদের অসুবিধা হবে মনে করে এই ব্যবস্থা। আমিও মঠের গাছের কাঁঠাল ইচোর রান্নার জন্য ও টাকের জন্য কাঁচা আম দিয়ে দিলাম। গুরুবাড়ীর জন্য যে তাঁর কত ভালবাসা কত প্রেম তাহা মাপ করা যায় না। লিচু সরিয়ে রাখতেই বলিলাম বাবা এ কয়টা আপনি খেয়ে ফেলুন আরও আছে দিগসুই পাঠিয়ে দিব। এ কথায় ঠাকুর থালা হইতে আর ২/৩ টি নিয়ে গেলেন। মঠে তখন ২টি কোঠা থাকার জন্য নির্ম্মাণ হয়েছে। একটিতে ঠাকুরের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হইল। পাড়ার নামের দল বারান্দায় ঠাকুরকে সারারাত নাম শুনাল। ভোরে ঠাকুর উঠে বললেন, ‘ছেলেরা সারারাত অপূর্ব নাম করেছে।’ এরপর ঠাকুর সারাদিন রণরঙ্গে মেতে গেলেন। প্রথমে প্রণাম পর্ব সেরে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেল ৮/১০ হাজার লোকের ভীড়। শেষে ঠাকুরকে উঠিয়ে আনলে ফলভোগ গ্রহণ করে দীক্ষা দিতে লাগলেন, প্রায় ৩০০ দীক্ষার্থীকে উদ্ধার করে ভোগ নিলেন। বিশ্রামের পর রাত্রে বর্দ্ধমান মোহান্তস্তল চলে গেলেন। সেখানে ৩ দিন যজ্ঞ করে কারকবেড়ে প্রভৃতি স্থান ঘুরে গঙ্গাসাগর গিয়ে মৌন নেন। শ্রীযোগেন্দ্র পন্ডিত মহাশয়ের সংকল্প ছিল গঙ্গাসাগরকে নিত্যতীর্থে পরিণত করা। তিনি বলেন, ‘বাংলায় এমন একটি স্থান আজও আছে যাহা সমস্ত শাস্ত্রে প্রশংসিত এবং ভারতের সমস্ত প্রদেশের লোক অতি শ্রদ্ধার চক্ষে দর্শন করিতে আগমন করিয়া থাকেন। সেই স্থানটি হল গঙ্গাসাগর। (মিলনে – কিঙ্কর শঙ্করনাথ)