শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম || প্রকাশ কাল - March 6 2018


শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরকে তুষ্ট কর, সকলেই তুষ্ট হবে। তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্‌। ঠাকুর যখন দ্রৌপদীর হাঁড়ির শাক খেয়ে বললেন, আমি তৃপ্ত হয়েছি, তখন জগৎসুদ্ধ জীব তৃপ্ত – হেউ ঢেউ হয়েছিল। কই মনিরা খেলে কি জগৎ তুষ্ট হয়েছিল – হেউ ঢেউ হয়েছিল?

(হাজরার প্রতি) – জ্ঞানলাভের পরও লোকশিক্ষার জন্য পূজাদি কর্ম রাখে। ‘আমি কালীঘরে যাই, আবার ঘরের এইসব পট নমস্কার করি; –  তাই সকলে করে। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে যদি না করে তাহলে মন হুসফুস করবে।’

‘‘বটতলায় সন্ন্যাসীকে দেখলাম। যে আসনে গুরুপাদুকা রেখেছে তারই উপরে শালগ্রাম রেখেছে! ও পূজা করছে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি এতদূর জ্ঞান হয়ে থাকে তবে পূজা করা কেন? সন্ন্যাসী বললে, – সবই করা যাচ্ছে – এ ও একটা করলাম। কখনও ফুলটা এ-পায়ে দিলাম; আবার কখনও একটা ফুল ও-পায়ে দিলাম।’

‘দেহ থাকতে কর্মত্যাগ করবার জো নাই – পাঁক থাকতে ভুড়ভুড়ি হবেই।’’

(হাজরাকে) – ‘‘এক জ্ঞান থাকলেই অনেক জ্ঞান আছে। শুধু শাস্ত্র পড়ে কি হবে?

‘‘শাস্ত্রে বালিতে চিনিতে মিশেল আছে – চিনিটুকু লওয়া বড় কঠিন। তাই শাস্ত্রের মর্ম সাধুমুখে গুরুমুখে শুনে নিতে হয়। তখন আর গ্রন্থের কি দরকার?

‘‘চিঠিতে খবর এসেছে, – ‘পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবা – আর একখানা লালপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ এখন চিঠিখানি হারিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চারিদিকে খোঁজে। অনেক খোঁজবার পর চিঠিখানি পেলে, পড়ে দেখে, – লিখছে – ‘পাঁচ সের সন্দেশ আর একখানা লালপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ তখন চিঠিখানি আবার ফেলে দেয়। আর কি দরকার? এখন সন্দেশ আর কাপড়ের যোগাড় করলেই হল।

(মুখুজ্জে, বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) – ‘‘সব সন্ধান জেনে তারপর ডুব দাও। পুকুরের অমুক জায়গায় ঘটিটা পড়ে গেছে, জায়গাটি ঠিক করে দেখে নিয়ে সেইখানে ডুব দিতে হয়।

‘‘শাস্ত্রের মর্ম গুরুমুখে শুনে নিয়ে, তারপর সাধন করতে হয়। এই সাধন ঠিক ঠিক হলে তবে প্রত্যক্ষ দর্শন হয়।

‘‘ডুব দিলে তবে তো ঠিক ঠিক সাধন হয়। বসে বসে শাস্ত্রের কথা নিয়ে কেবল বিচার করলে কি হবে? শ্যালারা পথে যাবারই কথা – ওই নিয়ে মরছে – মর শ্যালারা, ডুব দেয় না।

‘‘যদি বল ডুব দিলেও হাঙ্গর-কুমিরের ভয় আছে – কাম-ক্রোধাদির ভয় আছে।– হলুদ মেখে ডুব দাও – তারা কাছে আসতে পারবে না। বিবেক-বৈরাগ্য হলুদ।’’

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – তিনি আমায় নানারূপ সাধন করিয়েছেন। প্রথম, পুরাণ মতের – তারপর তন্ত্র মতের, আবার বেদ মতের। প্রথমে পঞ্চবটীতে সাধনা করতাম। কখনও ব্যাকুল হয়ে ‘মা! মা!’ বলে ডাকতাম – বা ‘রাম! রাম!’ করতাম।

‘‘যখন ‘রাম রাম’ করতাম তখন হনুমানের ভাবে হয়তো একটা ল্যাজ পরে বসে আছি! উন্মাদের অবস্থা। সে সময়ে পূজা করতে করতে গরদের কাপড় পরে আনন্দ হত – পূজারই আনন্দ!

‘‘তন্ত্র মতের সাধনা বেলতলায়। তখন তুলসী গাছ – সজনের খাড়া – এক মনে হত!

‘‘সে অবস্থায় শিবানীর উচ্ছিষ্ট – সমস্ত রাত্রি পড়ে আছে – সাপে খেলে কি কিসে খেলে তার ঠিক নাই – ওই উচ্ছিষ্টই আহার।
‘‘কুকুরের উপর চড়ে তার মুখে লুচি দিয়ে খাওয়াতাম, আর নিজেও খেতাম। সবং বিষ্ণুময়ং জগৎ। – মাটিতে জল জমবে তাই আচমন, আমি সে মাটিতে পুকুর থেকে জল দিয়ে আচমন কল্লাম।
‘‘অবিদ্যাকে নাশ না করলে হবে না। আমি তাই বাঘ হতাম – হয়ে অবিদ্যাকে খেয়ে ফেলতাম!
‘‘বেদমতে সাধনের সময় সন্ন্যাস নিলাম। তখন চাঁদনতে পড়ে থাকতাম – হৃদুকে বলতাম, ‘আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, চাঁদনিতে ভাত খাব’!’’
(ভক্তদের প্রতি) – ‘‘হত্যা দিয়ে পড়েছিলাম! মাকে বললাম, আমি মুখ্যু – তুমি আমায় জানিয়ে দাও – বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে – নানা শাস্ত্রে – কি আছে।
‘‘মা বললেন, বেদান্তের সার – ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। যে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের কথা বেদে আছে, তাঁকে তন্ত্রে বলে, সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ – আবার তাঁকেই পুরাণে বলে, সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ।
‘‘গীতা দশবার বললে যা হয়, তাই গীতার সার। অর্থৎ ত্যাগী ত্যাগী!
‘‘তাঁকে যখন লাভ হয়, বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্র – কত নীচে পড়ে থাকে। (হাজরাকে) তখন ওঁ উচ্চারণ করবার জো নাই। – এটি কেন হয়? সমাধি থেকে অনেক নেমে না এলে ওঁ উচ্চারণ করতে পারি না।
‘‘প্রত্যক্ষ দর্শনের পর যা যা অবস্থা হয় শাস্ত্রে আছে, সে সব হয়েছিল। বালকবৎ, উন্মাদবৎ, পিশাচবৎ, জড়বৎ।
‘‘আর শাস্ত্রে যেরূপ আছে, সেরূপ দর্শনও হত।
‘‘কখন দেখতাম জগৎময় আগুনের স্ফুলিঙ্গ!
‘‘কখন চারিদিকে যেন পারার হ্রদ, – ঝক্‌ঝক্‌ করছে। আবার কখনও রূপা গলার মতো দেখতাম।
‘‘কখন দেখতাম রঙ মশালের আলো যেন জ্বলছে!
‘‘তাহলেই হল, শাস্ত্রের সঙ্গে ঐক্য হচ্ছে।’’
‘‘আবার দেখালে, তিনিই জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন! ছাদে উঠে আবার সিঁড়িতে নামা। অনুলোম বিলোম।
‘‘উঃ! কি অবস্থাতেই রেখেছে! – একটা অবস্থা যায় তো আর একটা আসে। যেন ঢেঁকির পাট। একদিক নিচু হয় তো আর একদিক উঁচু হয়।
‘‘যখন অন্তর্মুখ – সমাধিস্থ – তখনও দেখছি তিনি! আবার যখন বাহিরের জগতে মন এল, তখনও দেখছি তিনি।
‘‘যখন আরশির এ-পিঠ দেখছি তখন তিনি। আবার যখন উলটো পিঠ দেখছি তখনও তিনি।’’
মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মুখু্জ্জে প্রভৃতিকে) কাপ্তেনের ঠিক সাধকের অবস্থা।
‘‘ঐশ্বর্য থাকলেই যে তাতে আসক্ত হতেই হবে, এমন কিছু নয়। শম্ভু (মল্লিক) বলত, ‘হৃদু, পোঁটলা বেঁধে বসে আছি।’ আমি বলতাম কি অলক্ষণে কথা কও! –
‘‘তখন শম্ভু বলে, ‘না, – বলো, এ-সব ফেলে যেন তাঁর কাছে যাই!’
‘‘তাঁর ভক্তের ভয় নাই। ভক্ত তাঁর আত্মীয়। তিনি তাদের টেনে নেবেন। দুর্যোধনেরা গন্ধর্বের কাছে বন্দী হলে যুধিষ্ঠিরই উদ্ধার করলেন। বললেন, আত্মীয়দের ওরূপ অবস্থা হলে আমাদেরই কলঙ্ক।’’
প্রায় নয়টা রাত্রি হইল। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় কলিকাতা ফিরিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। ঠাকুর একটু উঠুয়া ঘরে ও বারান্দায় পদচারণ করিতে করিতে বিষ্ণুঘরে উচ্চ সংকীর্তন হইতেছে শুনিতে পাইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করাতে একজন ভক্ত বলিলেন, তাহাদের সঙ্গে লাটু ও হিরশ জুটিয়াছে। ঠাকুর বলিলেন, ও তাই!
ঠাকুর বিষ্ণুঘরে আসিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তেরাও আসিলেন। তিনি শ্রীশ্রীরাধাকান্তকে ভুমিষ্ঠ হইয়া প্রাণাম কিরেলন।
ঠাকুর দেখিলেন, যে ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মণেরা – যারা ভোগ রাঁধে, নৈবেদ্য করে দেয়, অতিথিদের পরিবেশন করে এবং পরিচারকেরা, অনেকে একত্রে মিলিত হইয়া নাম সংকীর্তন করিতেছেন। ঠাকুর একটু দাঁড়াইয়া তাহাদের উৎসাহ বর্ধন করিলেন।
উঠানের মধ্যে দিয়া ফিরায়া আসিবার সময় ভক্তদের বলিতেছেন –
‘‘দেখো, এরা সব কেউ বেশ্যার বাড়ি যায়, কেউ বাসন মাজে!’’
ঘরে আসিয়া ঠাকুর নিজ আসনে আবার বসিয়াছেন। যাঁহারা সংকীর্তন করিতেছিলেন, তাঁহারা আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
ঠাকুর তাঁহাদিগকে বলিতেছেন – ‘‘টাকার জন্য যেমন ঘাম বার কর, তেমনি হিরনাম করে নেচে গেয়ে ঘাম বার করতে হয়।
‘‘আমি মনে করলাম, তোমাদের সঙ্গে নাচব। গিয়ে দেখি যে ফোড়ন-টোড়ন সব পড়েছে – মেথি পর্যন্ত। (সকলের হাস্য) আমি আর কি দিয়ে সম্বরা করব।
‘‘তোমরা মাঝে মাঝে হরিনাম করতে অমন এসো।’’
মুখুজ্জে প্রভৃতি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।