ভক্তের ক্ষমতা
আমরা গুরুমুখ থেকেই ভগবানের কথা শুনি। গুরুই আমাদের প্রত্যক্ষ দেবতা। ভগবান নিজে যা পারেন না, গুরু তা পারেন।
‘‘কৃষ্ণ যদি রুষ্ট হন গুরু তরিবারে পারে।
গুরু যদি রুষ্ট হন কৃষ্ণ তরিবারে নারে।’’
সুতরাং ভক্তের ক্ষমতা ভগবানের চেয়েও বেশি। তারই একটি গল্প এখানে বলব।
এক দেশে এক চাষী ছিল। তার বিরাট খেত-খামার। কিন্তু কোন ছেলেপুলে ছিল না। এই জন্য তার মনে একটা দুঃখ ছিল, কে তার এই সম্পত্তি ভোগ করবে তা ভেবে।
দেবর্ষি নারদ ত্রিভুবন ভ্রমণ করেন। তাঁর অবাধ গতি। একবার উনি ওই চাষীর বাড়ি আসেন। চাষী তার মনের কথা জানায় এবং বলে –‘দেবর্ষি আপনি তো বৈকুন্ঠে যান। একবার ভগবানকে জিজ্ঞেস করবেন – আমার কপালে ছেলেপুলে আছে কি না’। নারদ ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন। যথারীতি নারদ বৈকুন্ঠে গিয়ে ওই চাষীর কথা ভগবানকে বলেন। ভগবান উত্তর দেন – ‘না, ও যা কর্ম করেছে তাতে ওর তো ছেলেপুলে হতে পারে না।’
নারদ পুনরায় সেই চাষীর কাছে গিয়ে খবরটি বলেন – ‘ভগবান বলেছেন – তোমার কপালে ছেলেপুলে নেই, তা আর দুঃখ করে কী করবে? কপালে যা আছে তা তো ভেগ করতেই হবে।’
এরপর প্রায় ৭/৮ বৎসর গত হয়েছে। নারদ আবার সেই চাষীর বাড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। চাষীর বাড়ির দিকে নজর পড়তেই দেখলেন বাইরের রকে চারটি পিঠোপিঠি ছেলে খেলা করছে। কেই পাঁচ বছরের, কেউ চার বছরের, কেউ তিন বছরের, কেউ দু-বছরের। নারদ ভাবলেন, চাষীর তো ছেলে হবে না। তবে এরা কারা? কৌতুহলী হয়ে নারদ চাষীকে ডাকলেন। চাষী এসে দেবর্ষিকে দেখে একেবারে গদগদ চিত্তে দাড়াল। নারদ জিজ্ঞেস করলেন – ‘এরা কারা?’
চাষী উত্তর করল – ‘‘প্রভু আপনি তো বলেছিলেন যে আমার ছেলে হবে না। কিন্তু আপনি চলে যাওয়ার দু-চার দিন পর একজন সাধু এখান দিয়ে চিমটে বাজাতে বাজাতে যাচ্ছিলেন আর মুখে বলছিলেন – ‘এক রোটি দেগা তো দো লেড়কা হোগা।’ আমি মনের আনন্দে তাঁকে চারখানা রুটি দিয়েছিলাম। তারপর চারটি ছেলে হয়েছে।’’
নারদ শুনে মনে মনে বিস্মিত হলেন। ভাবলেন – এ কী করে সম্ভব হয়? ভগবান কি তাঁকে মিথ্যে কথা বলেছেন? ভগবান চাষীর ভাগ্যে ছেলেপুলে নেই বললেন আর একজন সাধু তা দিয়ে গেলেন? এ কেমন করে হয়? নারদ বৈকুন্ঠে চলে গেলেন। বৈকুন্ঠে এসে নারদ নারায়ণকে বললেন – ‘আপনি কেন আমায় মিথ্যা বললেন ওর ছেলে হবে না বলে? আর আমি দেখে এলাম তার চারটে ছেলে হয়েছে।’
ভগবান উত্তর করলেন – ‘আমার মতে ওর তো ছেলে হওয়ার কথা নয়। ওর তো সাধুর কৃপায় হয়েছে। ভক্ত ওকে কৃপা করেছে। কৃপা করে সন্তান দিয়েছে।’
নারদ তো শুনে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন – ‘ভগবান, আপনি যা পারলেন না, তা একজন সাধু পারলেন? আপনার থেকে তাঁর ক্ষমতা বেশি?
ভগবান বললেন – ‘নারদ, তুমি আসল তত্ত্বটাই বোঝনি। আমি ভগবান বটে। কিন্তু আমার ক্ষমতা জীব যেমন কর্ম করবে সেইমতো ফল দেওয়া। তার বেশি নয়। কিন্তু সাধুরা দীনবৎসল। তাদের অধিক কৃপা। তারা যদি কাউকে পুত্র হওয়ার বর দেয়, তাদের সেই কথা রক্ষার জন্য আমি আমার কথা খন্ডন করি।’
নারদ বললেন – ‘সে কী প্রভু? আপনি ভক্তের কথা রক্ষার জন্য নজের কথা ভঙ্গ করেন?’
ভগবান বললেন – ‘কেন নারদ? আমি তো আগেও করেছি। তুমি ভুলে গেছ। আমার তো প্রতিজ্ঞা ছিল – আমি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করব না। ভীষ্ম আমার ভক্ত, তা তুমি জানো। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল আমাকে দিয়ে অস্ত্র ধারণ করাবে। আমি আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে রতচক্র নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভক্ত ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলাম। এই জন্যই আমার ভক্তের যে নাশ নেই এই প্রতিজ্ঞাটা আমি না করে অর্জুনকে করতে বলেছিলাম – ‘কৌন্তেয়প্রতিজনীহি ন-মে ভক্তঃপ্রণশ্যতি।
নারদ উত্তর করলেন – ‘প্রভু! আপনার এই উক্তির মধ্যে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা করার কথা কোথায় আছে?’
ভগবান হেসে বললেন – ‘‘নারদ। বীণা বাজিয়ে বেড়াও। ব্যাকরণটা ভাল করে জানো না। ‘প্রতিজানীহি’ মানে জানো? ‘প্রতি-জ্ঞা’ ধাতুর অর্থ কেবল ‘জানা’ নয়, প্রতিজ্ঞা করা’। অর্জুনকে প্রতিজ্ঞা করতে বলার অর্থ – আমার প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করি। কিন্তু আমার ভক্ত অর্জুন যদি প্রতিজ্ঞা করে ‘আমার ভক্তের বিনাশ নেই’ এই বলে, তা হলে সেই উক্তি আমি রক্ষা করব।’’
নারদ হাত জোড় করে বললেন – ‘‘ধন্য ভগবান! ধন্য তোমার ভক্ত।’’