সীতারাম লীলাস্মরণে

কিঙ্কর শরণানন্দ || প্রকাশ কাল - April 18 2018


রোমাঞ্চ হচ্ছে তা ওঙ্কারের টানের জন্য। আজ জনৈক শিষ্যকে মন্ত্রগ্রাম দিয়ে বললেন – ‘‘অধিকার দেওয়া রইলো, প্রয়োজন বুঝলে দিতে হবে, — তবে আগে নিশ্চিন্ত হ’, নিজে কৃতার্থ হলে তবে….।’’ একসময় বল্লেন ‘‘যত বিপর্য্যয়ই আসুক না কেন শাস্ত্রকে ধরে থাকবে।’’ বাবার বুকের ব্যথা আজ অনেক ভাল।

২২/৩/৮৬, বাইরে থেকে জানলার পর্দা সরিয়ে কোন দর্শনার্থী দর্শন করার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে বাবা রসিকতার সুরে বলে উঠলেন, ‘‘কে রে উঁকি মারন্তি?’’

আকাশটা একটু মেঘলা করে আছে, বলে উঠলেন, ‘‘রেন কাম্‌’’। কিছুক্ষণ থেকে বললেন – ‘‘বাইরে নয় মাথায় (নাদ)।’’

২৩শে আষাঢ়, কথা প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে আলোচনা উঠলে শ্রীশ্রীবাবা বলেন – ‘‘তাঁর জীবনে একমাত্র ধনী কামারণীর কাছ থেকে ভিক্ষে নেওয়া ছাড়া কোন অশাস্ত্রীয় কাজ দেখা যায়নি। … ’’ একসময় বলেন – ‘‘এখন সব আকাশময় দেখছি। আকাশ পাঁচ রকম…।’’

জনৈক ভক্ত – ‘কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা নাদ শোনা যায় কিনা?’

বাবা – ‘‘ঈশ্বর মন বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় একই।’’

আজ ২৪শে আষাঢ়, গুরুপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে নীলাচলে উৎসব। শ্রীশ্রীবাবা সকালে শ্রীনিবাস থেকে নীলাচলে গেলে আশ্রম প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে। ‘বাংলা থেকে কারো আসা বারণ’ পত্রিকাতে এরূপ নির্দ্দেশ দেওয়া থাকলেও প্রায় আড়াইশো লোকের ভিড় হয় – বাকী স্থানীয়। নাটমন্দিরে গুরুপূজা, পুষ্পাঞ্জলি প্রভৃতি অনুষ্ঠান সমাধা হল। উড়িষ্যার রাজ্যপাল প্রধান অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যার সময় শ্রীশ্রীবাবার উপস্থিতিতে প্রার্থনা হল। পরে বাবা শ্রীসদানন্দদাকে কিছু বলতে বললে তিনি ‘নাম’ ও বাবার মহিমা সম্বন্ধে কিছু বললেন। বাবাও সংক্ষেপে কিছু উপদেশ দিলেন।

পরের দিন সন্ধ্যার পর শ্রীশ্রীবাবা সহ আমরা শ্রীনিবাসে ফিরে এলাম।

২৬শে সাকালে শৌচে যাবার পথে হাসতে হাসতে সকলকে বলছেন ‘‘বেশী কাছে থেক না বাবা! এ ভীষণ ছোঁয়াচে রোগ! সর্বদা ওঁগুরু জয়গুরু চলছে, একপল অনুপল বিরাম নেই – অবিচ্ছিন্নভাবে চলেছে ৪৩ বছর ধরে।’’ এখন ধ্যান ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না, বলছেন – ‘‘পড়ব কি! গীতা ছুঁতেই পারছি না। উচ্চারণ করব ধর্মক্ষেত্রে – এ –- এ – এ  কুরুক্ষেত্রে এ – এ – এ আটকে যাচ্ছে, সব লয় হয়ে যাচ্ছে।’’

কুছুদিন যাবৎ রাত্রে খাবার আগে এত বেশী ঘুমিয়ে পড়ছেন (আমাদের চোখে) যে ডেকে, পায়ে হাত বুলিয়ে কিছুতেই তোলা যায় না। শেষে প্রচন্ড চিৎকার করে নাম ধরলে তবে ঘুম ভাঙে।

৩০শে আষাঢ় সকালে জগন্নাথ মন্দির, গম্ভীরা, সিদ্ধবকুল, লীলাকুঞ্জ, সরোজিনী মঠ হয়ে নীলাচলে। দুপুরে ঐখানেই ভোগগ্রহণান্তে বিকেলে পুরী এক্সপ্রেসে কলকাতা রওয়ানা।

৩১শে রাত্রি আটটায় হাওড়া থেকে অমৃৎসর মেলে বারাণসী যাত্রা। পরদিন আষাঢ় সংক্রান্তির দুপুরে কাশী রামাশ্রমে। বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণা দর্শন সেরে আশ্রমে ওঠার ইচ্ছা ছিল কিন্তু মালপত্রের জন্য তা আর হল না, সোজা আশ্রমে যেতে হল। শ্রীনামমঞ্চের দক্ষিণ দিকে ছোট্ট ঘরটি শ্রীশ্রীবাবার জন্য নির্দষ্ট – যে ঘরে কেটেছে ১৩৮৩ সালের সারা শীতকাল – রাম নাম গানে, রামধ্যানে – রামভাবে বিভোর হয়ে।

গঙ্গা দর্শনে আনন্দে আত্মহারা শ্রীশ্রীবাবা আশ্রমের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গোলাকৃতি বারান্দায় বসে শান্ত অনিমেষ নয়নে দর্শন করছেন গঙ্গা মাকে। গঙ্গামাহাত্ম্য বলতে গিয়ে বললেন –

‘‘গঙ্গা গঙ্গেতি যো ব্রূয়াদ্‌ যোজনানাং শতৈরপি।

মুচ্যতে সর্ব্বপাপেভ্যো বিষ্ণুলোকং স গচ্ছতি।।’’

‘‘একদিন কৈলাসে পার্ব্বতী দেবী মহাদেবকে প্রশ্ন করলেন – গঙ্গার মর্ত্ত্যে অবতরণে মর্ত্ত্যের সকলেরই কি মুক্তি হবে? শঙ্কর জানালেন – গঙ্গার স্নান সেরে যে ভাববে আমি নিষ্পাপ, স্নানের সুফল তারই।

গঙ্গামাহাত্ম্যের মর্মটুকু প্রত্যক্ষবোধের জন্য হর-পার্ব্বতী ছদ্মবেশে গঙ্গাতীরে উপস্থিত হলেন। শঙ্কর শব হয়ে রইলেন পার্ব্বতীর কোলে – সৎকারের অপেক্ষায়। সদ্যস্বামীহারা যুবতী রমণীবেশী পার্ব্বতী দেবী কাঁদছেন, সৎকারের জন্য সাহায্য চাইছেন। শিবের ইঙ্গিতে বলছেন শিবের শেখান কথা – কোন পাপী যদি শব স্পর্শ করে তৎক্ষণাৎ তারও মৃত্যু হবে। সেদিন গঙ্গাস্নানের ত্রিকোটি কুলোদ্ধার মহাযোগ। গঙ্গার ঘাটে স্নানযাত্রীর ভীড় থাকলেও কেউই সৎকারের সাহায্যে এগিয়ে এল না।

এদিকে বেলা গড়িয়ে পড়েছে এমন সময় দেখা গেল এক মাতাল গঙ্গাস্নানে এসেছে। শিবের ইঙ্গিতে পার্ব্বতী দেবী চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। মাতাল এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল ব্যাপার কি? ‘সন্ধ্যা হয়ে এলো অথচ স্বামীর সৎকার হ’ল না’ – বলে রমণী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কোন দ্বিধা না করে মাতাল হাত বাড়াতে ছদ্মবেশী পার্ব্বতী দেবী বাধা দিয়ে জানালেন যদি কিছু পাপ করে থাকো তো শব ছুঁয়ো না কারণ তাহলে তোমার‍ও মৃত্যু হবে। মাতাল শুনে হেসে বলল – তাহলে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসি, তারপর তোমার স্বামীর সৎকার আমিই ক’রব। মাতাল টলতে টলতে গঙ্গায় ঝাঁপ দিল গভীর আত্মপ্রত্যয়ে – স্থির বিশ্বাস স্নানের শেষে সে নিষ্পাপ হবেই। শিব পার্ব্বতীকে দেখালেন গঙ্গাস্নানে মুক্তি কাদের হবে। তাঁরা অন্তর্হিত হলেন।’’

এদিকে গঙ্গার জল বেড়ে আশ্রম প্রাঙ্গন ছাড়িয়ে ভিতরে এসেছে। গত বর্ষায় বাবার ঘরের মধ্যে হাঁটুজল হয়ে গিয়েছিল শুনে আনন্দে হাততালি দিয়ে বললেন – ‘‘বাঃ বাঃ বেশ ভালই হবে, বেশ তক্তপোষের ওপর বসে ঘরের মধ্যেই গঙ্গা দর্শন করতে পারব।…. একটা ছিপ থাকলে বেশ হত, আমরা এখানে থেকে মাছ ধরতে পারতাম!’’ পরে – ‘‘ছিপ এখন আমাদের নাশানের লাঠি হয়ে গেছে – কি বল?’’ আবার ডেকে – ‘‘জানিস্‌, ভাগীরথী মঠের কোল ঘেঁসে যে (ক্ষীণ কটি) গঙ্গাটি হলেন – ‘ছোট মা’, হৃষীকেশ আশ্রমের পাশে তিনি – ‘বড় মা’, আর (স্ফীতোদরা) কাশীর গঙ্গা – ‘ঠাকুমা’।’’

৪ঠা শ্রাবণ। বিকেলে চৌষট্টি ঘাট থেকে নৌকা যোগে দশাশ্বমেধঘাট পর্য্যন্ত গিয়ে ওখান থেকে কাঁধে চড়ে বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শন করে ফেরার পথে নৌকায় হরিশ্চন্দ্র ঘাট পর্য্যন্ত বেড়িয়ে সন্ধ্যার আগে আশ্রমে ফিরে এলেন। বিশ্বনাথ অন্নপূর্ণা দর্শনের জন্য ক’দিন খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিশ্বনাথ মন্দিরের ছোট জায়গা, ফুল, বেলপাতা জলে অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য বাবা রসিকতা করে বল্লেন – ‘‘তোমরা যাই বল বাপু বিশ্বনাথের চেয়ে জগন্নাথের qualification অনেক বেশী – যেমন ঠাকুর, তেমন মন্দির, তেমন জায়গা। কোনটাতেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারবে না। তা বলে আমি বিশ্বনাথকে নিন্দে করছিনে – যা দেখছি, তাই বলছি।’’ কথা প্রসঙ্গে এক সময় – ‘‘অ-কার হল স্থূলদেহ, উ-কার জ্যোতি, ম-কার হল নাদ। পিতৃবীর্য্যে যে শরীর তৈরী হয় সেটা স্থূল দেহ। পঞ্চপ্রাণ, মন, বুদ্ধি, দশ ইন্দ্রিয় মানবের মধ্যে থাকলেও শ্রীগুরুদেব কর্ণে মন্ত্র না দেওয়া পর্য্যন্ত তা আকার প্রাপ্ত হয় না। গুরুদেব কর্ণযোনিতে মন্ত্রদান করলে তবে তা জ্যোতি আকার ধারণ করে, অর্থাৎ সূক্ষ্ম দেহের জাগরণ হয়। এবার গুরুদত্ত মন্ত্রজপ করতে করতে নাদ এবং জ্যোতি লাভ হয় শিষ্য তখন আকাশময়ী কারণদেহ লাভ করে। তারপর কোটিসূর্য্যসমপ্রভ অনুপরিমাণ মহাকারণ….।’’

৫ই সকালে – ‘‘কি স্মরণশক্তিরে বাবা! একটুও ভুলছে না, ঠিক সমানে ওঁগুরু জয়গুরু করে চলেছে ঘুমোবার সময় শুনতে পাই না, ঘুমিয়ে পড়বার পূর্ব্ব মুহূর্ত পর্য্যন্ত শুনতে পাই, আবার যেই ঘুম ভাঙ্গবে অমনি সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়।’’

স্বামীজী – ঘুমোবার সময় কি মন থাকে না?

বাবা – ‘‘নিশ্চয়ই।’’

তা হলে শোনা যায় না কেন?

‘‘এতো প্রাণের কাজ…।’’

বিকালে একবার দরজার কাছে বসে বাহিরে দর্শনার্থীদের দর্শন দেন। আজ বললেন ‘‘শুধু দর্শন দেওয়া নয়, এ’কেও দর্শন করতে হয়। বড় অস্বস্তি হ’চ্ছে। কেউ ৫০ বছরের মায়ী-হাতে ঘড়ি, কেউ বা পাতলা রঙিন কাপড় এই সব পরে আসে, সব এ’কেও দেখতে হয়, না না কি অন্যায়, আমি ওসব দেখবো কেন? কাল থেকে মাধব দর্শন দেবে (যেহেতু মাধবস্বামী বলেছিলেন দর্শন দেবার জন্য)।

৬ই শ্রাবণ সকালে শৌচাদির পর ধ্যানে বসেন। কিছুক্ষণ পরে ধ্যানভাঙ্গলেও বেলা প্রায় ১০টা পর্য্যন্ত বাক্‌ বন্ধ থাকে। বিকেলে দেবীদাসদার সাথে বাবার কথা চলছিল। বাবার দর্শন সম্বন্ধে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন – পূর্ণতা প্রাপ্তি কি? সেই সময় বক্তার সাথে শ্রোতা কি কোন একত্র মিলন অনুভব করেছিলেন?

বাবা – ‘‘পূর্ণতা প্রাপ্তি অর্থে ‘যদা যদা’ …একত্র অনুভব নয় ‘আমিই সেই’ এই অনুভব হয়েছিল … সেই সময় যে একটা পাগলাটে অবস্থা তা প্রায় ৮ মাস ছিল, তখন যেন সাক্ষাৎ ভগবানের ক্ষমতা অনুভব করতাম। কোন অন্যায় বিষয়ের প্রতিবাদ করতে বন্দুমাত্র ইতস্ততঃ ভাব ছিল না। তারপর থেকে আর কখনও এই ভাবে আসেনি… ইচ্ছা করলেও আসবে না। যখন আসবে, না জানিয়েই হঠাৎ আসবে, এসেছিলও তাই। সেই থেকে সেব্য-সেবক ভাবে আছি। একটা লক্ষ্য করবার জিনিষ হ’ল জীবনে কখনও বুভূতির দিকে যাইনি, এমন কি গীতার বিভূতি যোগও বাদ দিয়ে পড়তাম এক এক সময়।’’

জনৈক সেবক এক সময় জিজ্ঞাসা করলেন – আপনার কোন্‌টা ভাল লাগছে পুরী না কাশী? উত্তরে বাবা বললেন – ‘‘ভগবান রামনুজ সেবক গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন গোবিন্দ! তুমি তো সারা ভারত ঘুরলে কোন্‌ স্থান তোমার সবচেয়ে ভাল লাগলো? গোবিন্দ বললেন – গুরুদেব আমি তো কোন সময় ভারত ঘুরিনি, আমি সর্বদাই গুরুদেবের চরণ সেবায় ছিলাম, কি করে বলবো কোন্‌ স্থান সবচেয়ে ভাল! …. শ্রীরামচন্দ্র বনবাস কালে পঞ্চবটীতে এক সময় সীতামাকে জিজ্ঞাসা করলেন – চিত্রকূট ভাল না পঞ্চবটী ভাল? (মা উত্তর দিলেন) তুমি ভাল। এ পুরীও দেখেনি কাশীও দেখেনি, জয়গুরু ওঁগুরু-তে ডুবে আছে তবে সেখানে সমুদ্র, আর এখানে মা গঙ্গার কোলে বসে আছি।’’

এক সময় কথা প্রসঙ্গে বললেন – ‘‘এখনও তৃপ্ত নই, এই ওঁগুরু জয়গুরু-র একটা শেষ আছে সেই অপেক্ষায় বসে আছি, এরপর কি অবস্থা আসবে সে আর অনুমান করে লাভ কি, যা হবার তা তো ঠিক হয়েই আছে।’’ আজ বিকেলে আর দড়জার সামনে বসে সকলকে দর্শন দিলেন না, বল্লেন – ‘‘আমি কেন দর্শন করবো?’’ পিছনের জানালা দিয়ে উৎসাহী দর্শনার্থীরা দর্শন করে গেলেন। আজ থেকে এই নিয়মই চলবে ঠিক হল।

৭ই কখনও আপন মনে কখনও বা আমাদের কাছে রসিকতা করে বলছেন – ‘‘তোমাদের পুরীতে কত হাওয়া, আমাদের কাশীতে একটুও হাওয়া নেই – তোমাদের পুরীতে সমুদ্রের নোনাজল, আমাদের কাশীতে গঙ্গার ঘোলা জল।’’

বিকালে কয়েকজন সঙ্গিনী সহ গঙ্গা-মা (নবতীর্থ) এলেন বাবার দর্শনে। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে চলে গেলেন। বাবা ‘মনই সব, মনই ভগবান যা কিছু সব ওঁকারেই লয় হবে।’’

পরের দিন সকালে বিছানা থেকে উঠে বললেন – ‘‘পিঠ থেকে মাথা পর্য্যন্ত টান চলছে… ওঁঙ্কারের আকর্ষণ। গতকাল অমাবস্যা ছিল। দিনের বেলা বাবাকে অন্নই দেওয়া হয়েছিল, বাবা খেয়াল করেননি, আজ যখন জানতে পারলেন তখন খুব অসন্তুষ্ট হয়ে মাধবস্বামীকে বললেন – ‘‘গতকাল অমাবস্যায় ভাত খাইয়ে এবং নিজেরা খেয়ে খুব অপরাধ করেছ, অমাবস্যায় ভাত খেলে রস বাড়ে… তাছাড়া মাঝে মাঝে আহারের পরিবর্তনেরও তো একটা প্রয়োজন আছে। মাসে একদিন অমাবস্যা একদিন পূর্ণিমা আর দুটো একাদশী। এই চারটে দিন একটু রুটি ডালিয়া কি এমনই অসুবিধে করে?’’ বিজনে বিজয়া, মিলনযজ্ঞ, কথা রামায়ণ চাইলেন, অনেকদিন পরে আজ পড়া শুরু হ’ল। বিজনে বিজয়া পড়া আরম্ভ করলেন।

৯ই শ্রাবণ ঘুম থেকে উঠে বল্‌লেন ‘‘স্বপ্ন দেখছিলাম, ওঁগুরু জয়গুরু চলে গেছে, হরেকৃষ্ণ নাদ চরছে।’’ বিজনে বিজয়ার শেষ অংশ পড়ছেন –

বাল্মীকি। মা রঘুকুলরাজলক্ষ্মী! দশরথের পুত্রবধূ রামের প্রয়তমা ভার্য্যা, জনকনন্দিনি! তুমি নিষ্পাপা হয়েও স্বামী কর্ত্তৃক ত্যক্তা হয়েছ। তা আমি জানি।

সীতা। দেব আমি বড় অবাগিনী।

বাল্মীকি। মা, আমি তোমার পিতৃপুরুষ বাল্মীকি। তুমি যে কে তা আমি জানি মাগো – তব আশা পথ চেয়ে বসে আছি কত কাল। সকল সাধনা সিদ্ধি করিতে প্রদা আসিবি আশ্রমে মোর – ধ্যানযোগে হইয়া বিদিত চেয়ে আছি পথপানে।

মা, মা বৈকুন্ঠেশ্বরি জননি আমার, এস তব অধম তনয় বাল্মীকির পর্ণকুটিরেতে। এত কৃপা! এত কৃপা – আর কেহ কভু লভেনি কখন। রাম নাম – সাধনার মহাসিদ্ধি দিতে, এসেছিস জননী আমার। কত যুগ রাম নাম করি, স্তরে স্তরে রাম নাম রেখেছি সাজায়ে তোর – তরে।

চিদানন্দ ঘন রাম নাম করে খেলা নাচিয়া নাচিয়া। সেথা অণু পরমাণু করে রাম নাম, সাধন গৃহেতে মোর স্বতঃ উঠে রাম নাম ধ্বনি।

আয় মা, আয় মা সকল সাধনার সিদ্ধি স্বরূপিণী – জননি আমার!

আয় তপবনে। …

পড়তে পড়তে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তারপরে একেবারে স্থির। বেশ কিছুক্ষণ ঐ ভাবে থাকার পর ‘মিলন যজ্ঞ’ পড়তে আরম্ভ করলেন।

দেবীদাসদার সাথে কথা চলছে –

প্রথমে চুঁচড়োর দর্শন – ‘‘পঞ্চমুখে রাম্‌ রাম্‌ রাম্‌ ওম্‌ ওম্‌ ওম্‌ ওম্‌ পরে সাপের গর্জন…। সেই অবস্থায় স্থিতিলাভ করলে এত কাজ হত না। কাজ করছে তো ওঁগুরু, জয়গুরু, ৪৩ বছর ধরে অবিচ্ছিন্ন ভাবে।’’ –

ঘুমোবার সময় কি থাকে না?

বাবা – ‘‘না, ঘুমোবার সময় থাকলেও জ্ঞান থাকে না বলে, শোনা যায় না।… সহস্রদল পদ্ম প্রথম যে দল সেটি ১০০ দল, দ্বিতীয়টি ১৫০ দল, তৃতীয়টি ২০০ দল, চতুর্থটি ২৫০ দল, পঞ্চমটি ৩০০ দল, মোট সহস্রদল।… সম্পর্ক একজন্মের নয়, হয়তো জন্ম জন্মান্তরের কোন সম্বন্ধ আছে।… ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য একটা দল আছে তারাই ত্রেতা, দ্বাপর, কলি প্রত্যেক বারে সাজ পালটে আসে, নূতন দল তৈরী হয় না।’’

দুপুরে রামকৃষ্ণ (কালনা) মাছি তাড়াচ্ছে বাবার গা থেকে, বাবা রসিকতা করে বলছেন – ‘‘কি করে মশা মারতে হয় জানিস্‌? একটা খোলা গরম করতে হয়, তারপর মশার ঘাড়টা ধরে মুখটা গরম খোলায় ঘসে দিতে হয়।’’

১০/৪/৮৬ নিত্যকারের মত আজও সকালে শ্রীশ্রীবাবা শ্রীনাম মঞ্চ প্রদক্ষিণ সেরে ঠাকুরঘরে প্রণাম করে শরণের কাঁধে চড়ে গঙ্গা স্পর্শ করতে এলেন। একেবারে খাড়াই সিঁড়ি, আশ্রমের মধ্যে দিয়েই ভূগর্ভে নেমে গেছে, বর্ষার কাদা এবং শ্যাওলায় – তা খুবই বিপদজনক হয়ে উঠেছে। খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে নামছি – বাবা রসিকতার সুরে ভীতির ভান করে বলতে লাগলেন – ‘‘দেখো বাবা – যেন ফেলে দিও না – তাহলে সারাজীবন তোমাকে বদনাম সহ্য করতে হবে।’’ মা গঙ্গার ধারে গেছি বলছেন, ‘‘এবার ঝপাং করে ঠাকুর বিসর্জ্জন দিয়ে দাও।’’

বিকেলে বিলাসপুর থেকে মানিকদা এসেছেন। ইনি ডাক্তার। বাবা তার দিকে হতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – ‘‘একবার দেখতো হাতটা (নাড়ীটা)।’’

মানিকদা – আপনার হাত দেখবো না।

বাবা – ‘‘কেন দেখবি না রে? (একটু পরে) – রোগ থাকলে তো দেখবে। রোগই বল আর যোগই বল গোলমালটা ওই ওখানেই (বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন)।’’

১১ই সকালে ঠাকুরঘরে প্রণাম করতে গিয়ে দেখেন রাধাকৃষ্ণের ছবির উপরে একটা মা কালীর ছবি টাঙানো আছে। বাবা বললেন – ‘‘দেখ্‌ মায়ের ছবিটা অন্য কোথাও টাঙা, বৈষ্ণবরা দেখতে পেলে রেগে যাবে।’’

আজ বেশ কিছুক্ষণ বাক্‌ বন্ধ হয়ে থাকে। পরে স্বাভাবিক হলে – একজন প্রশ্ন করলেন – শ্রুতির (বেদ) সঙ্গে স্মৃতির নীতির বিরোধ বাঁধলে শ্রুতির নিয়ম পালনীয়, স্মৃতির সঙ্গে পুরাণের বিরোধ হলে স্মৃতি পালনীয়; পুরাণের সাথে দেশাচার বংশাচারের বিরোধ হলে পুরাণ পালনীয়, অবশ্য বিরোধ না হলে সমস্তই পালনীয় – এটা কি ঠিক?

বাবা বললেন – ‘‘হ্যাঁ ঠিক, এই কারণেই উৎকল প্রদেশের সর্ব্ব বর্ণের দশাশৌচমেনে নিতে পারি নি।’’ এক সময় কথা প্রসঙ্গে ‘‘সব বাঁধা, কারও কিছু করবার নেই। এই করবো এই করবো না, এটা করলে ভাল হত সবই মনের ভুল, আসলে যা হবার তা হয়েই আছে।’’

১২/৪/৮৬ পুরী থেকে পত্র এসেছে সেখানে খুব টানাটানি চলছে, ইতিমধ্যেই ২০০০ টাকা ঋণ হয়ে গেছে ইত্যাদি। বাবা শুনে বললেন – এতো খুব আনন্দের কথা –

আয়া আয় রোগ – আয়রে অভাব – আয়রে পীড়ন আয়।

আয় মহাশোক – আয় অপমান – যা আছিস্‌ সব আয়।

সবাই মিলিয়া করি গলাগলি – তুলিরে মধুর তান,

জয় জয় গুরু – জয় জয় নাম জয় জয় ভগবান।।

অর্থের অভাবে কেঁদনারে ভাই (ওই) পরম অর্থ লইয়ে

আসিছে প্রাণেশ – যাবে সব জ্বালা – পড়িবি তুই ঘুমায়ে।।

(শ্রীশ্রীনামরসায়ন)

কথা প্রসঙ্গে ‘‘পুরীর চেয়ে এখানে স্থিতি বেশী … দৃশ্য, দর্শন, দ্রষ্টা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ জাগিতক ভাব, যখন এর কিছুই থাকবে না তখন ব্রহ্মভাব। … বাহিরের আকাশও ব্রহ্ম, ভিতরের আকাশও ব্রহ্ম … এই যে ধ্যান এটা এ’র স্বাভাবিক ধ্যান – চেষ্টিত নয়।’’

বাবার ঘরের মধ্যে টিকটিকিগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে – বিছানায়, ঘরের মধ্যে পায়খানা করে অপরিষ্কার করছে। খাবার খুব ভালভাবে ঢাকা না দিলে নিশ্চিন্ত থাকা যায় না – তাই টিকটিকিগুলোকে তাড়াবার জন্য একটা লাঠি নিয়ে এসেছি। বাবার চোখে পড়তেই বাচ্ছা ছেলের মত গলা করে বলতে লাগলেন – ‘‘ওরে লাঠি কেন আনলি রে – মারবি না কি রে?’’

– টিকটিকি তাড়াবো।

– ‘‘ওরা কোথায় যাবে, ঘরের বাইরে ওদের থাকবার জায়গা কোথায়? এই বর্ষায় ওরা যাবে যে – তাইতো! ওদের তাড়াস্‌নি বাবা।’’

– ওরা ঘরের মধ্যে পায়খানা ক’রে ভীষণ ঘর নোংরা করে বাবা।

– ‘‘তবে দেখ্‌’’। ধ্যান ঘর থেকে তাড়ালাম, সব টিকটিকিগুলো বাবার ঘরে এলো। বাবার ঘর থেকে তাড়াবার জন্য যেই এসেছি – ‘‘ওরে বাবা, এঘর থেকে তাড়াসনি বাবা! ওরা তোর ঘর থেকে তো চলে এসেছে।’’ (বাবার ঘরের মধ্যেই তখন থাকতাম, বাবার ঘরের মধ্যেই মাঝখানে খানিকটা পার্টিশন দিয়ে ধ্যানঘর ছিল) এঘরেও তো পায়খানা করে নোংরা করবে।

– ‘‘করুগ্‌গে, আমাদের গায়ে হাগুক্‌, ওরা এখন যায় কোথা বল্‌ দেখি, আমার চোখের সামনে তাড়াস্‌নি বাবা।’’

বড় আকুতির সুরে বললেন কথাগুলি – তাই লাঠি রেখে এলাম। কিছুক্ষণ পরে টিকটিকিগুলোকে দেখে বাবা – ‘‘ওরে বাবা টিক্‌টিকি, তোরা লুকো বাবা, এখুনি তোদের তাড়াবে শেষকালে (চোখের আড়াল হলেই)। ৮৮ বছর বয়স হল, টিকটিকি তাড়াতে কাউকে দেখিনি, এই প্রথম দেখছি। একটা গল্প আছে তবে শোন্‌ –

একটা টিকটিকি এদিক ওদিক বার বার যাতায়াত করছে দেখে একজনের মনে সন্দেহ হল। তার সঙ্গে একজন জ্যোতিষী ছিল, তাকে টিকটিকির কথা বলতে সে বলল অমুক গ্রামে অমুকের বাড়ীতে একটা টিকটিকি আছে, আজই তার সাথে এই টিকটিকির বিয়ে হবে। তাই এত ছোটাছুটি করছে। এই শুনে ভদ্রলোক খুব ভাল করে টিকটিকিকে লক্ষ্য করতে লাগলো। এমন সময় অন্য একজন লোক ছাতা হাতে সেইখানে এল। ছাতাটা রেখে বসে তার কাজ মিটিয়ে ছাতা নিয়ে সে চলে গেল। ইত্যবসরে সেই টিকটিকিটা তার ছাতার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল – ভদ্রলোক তাকে অনুসরণ করে চললো, কিছু দূরে একটা বাড়ীতে তারা ঢুকলো। ছাতাটা রাখতেই টিকটিকিটা বরিয়ে এল, সেখানে আর একটা টিকটিকি ছিল, এ বেরিয়ে তার সাথে একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়লো – যেন এর জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। লক্ষ্যকারী ভদ্রলোক খোঁজ নিয়ে দেখলো জ্যোতিষীর বলা সেই গ্রামের ভদ্রলোকের এই বাড়ীটি।’’

গল্প শেষ হলে কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন – ‘‘হাঁচি – টিকটিকি – বাধা যে না শোনে – সে গাধা। একজন খুব টিকটিকি মান্‌তো। পাইখানা করতে গিয়ে বসতে যাবে কি অমনি টিকটিকি। কি আর করে কোন রকমে চেপে উঠতে যাবে কি অমনি – আবার টিকটিকি। বেচারার খুব পায়খানা পেয়েছে – সে না পারে বসতে না পারে উঠতে।’’

রাত্রে বাবা বিছানায় বসে আছেন, ঘরে আলোর কাছে ২/৩ টি বড় বড় টিকটিকি – বসে আছে, বাবা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাদের দিকে চেয়ে পরে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন – ‘‘টিকটিকিদের বাড়ী – ঘর-দোর এটা, আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। ওই দেখ ওরা এসে কত দুঃখু করছে আর ওদের পেছনে লাগিস্‌নে বাবা। ওরা সাতপুরুষ এখানে বাস করছে, ওদের‍ও তো একটা দাবী আছে।’’

১৩/৪/৮৬ সোমবার – গত ৮ই শ্রাবণ পড়া শুরু হলেও ‘রামের’ উপর লেখা বই ছাড়া অন্য কোন বই পড়তে পারতেন না – চেষ্টা করেও। আজ দেখছি বই খুলেছেন – ‘‘ভারতের সাধক’’। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল – দীর্ঘ কয়েকমাস শ্রীশ্রীবাবা কোন বই পড়তে পারছিলেন না, বই খুললেই টান ধরতো, সব প্রণবে গিয়ে মিশে যেতো (বলতেন)। এমনকি এখনও গীতা পড়তে পারছেন না। তাঁরই ভাষায় – ‘‘পড়বো কি? গীতা খুললেই যেই দেখি অর্জুন রথে বসে আছে আর ঠাকুর আমার সারথি হয়ে রথ চালাচ্ছেন তখনই আর পড়ার শক্তি থাকে না। দেখলেই সব জমে যায়। উচ্চারণ করবো কি, ধর্ম্মক্ষেত্রে – এ-এ-এ কুরুক্ষেত্রে এ-এ-এ সব ওঁকারে মিশে যায়।’’

১৪ই খেতে বসে ৩/৪ রকম ব্যঞ্জনাদি দেখে বললেন – ‘‘তোমরা বোধহয় ভুলে গেছ এর ৮৮ বছর বয়েস। তাছাড়া সাধুদের ১ বেলা করপাত্রে ভোজন করতে হয়। আর তোমরা যা আরম্ভ করেছ…।’’

১৬ই বৃহস্পতিবার। বই পড়তে পারছিলেন না যখন তখন এক অবস্থা, আবার এখন বই ধরলে আর মোটেই ছাড়ছেন না। স্বামীজী বল্‌লেন – বাবা এত পড়লে চোখ খারাপ হয়ে যাবে যে।

বাবা – ‘‘৮৮ বছর বয়সে একটা চোখ গেছে আরও ৮৮ হলে তবে আর একটা চোখ যাবে।’’

১৭ই ভারতের সাধকে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ খুলে পড়তে না পড়তেই ভাবান্তর – আর পড়তে পারলেন না তখনকার মত। কথা প্রসঙ্গে এক সময়ে বললেন – ‘‘এত সাধু মহা পুরুষদের জীবনী পড়েছি কই কেউতো এরকম ওঁগুরু জয়গুরু Difficulty তে পড়েনি। …

প্রত্যেক সাধুদের জীবন স্বতন্ত্র, কারও সাথে কারও মিল নেই।’’

১৮ই গীতা খুলে পড়বার চেষ্টা করেও পড়তে পারলেন না।

১৯/৪/৮৬ – লক্ষ্নৌ থেকে একটি মায়ী (অণিমা দেবী) এসেছেন, তাঁর আনুভূতি অদ্ভুত। তিনি কুটনো রান্না প্রভৃতি গৃহবধূর সমস্ত কাজই করতেন। যে কাপড় পরে থাকতেন তার মধ্যে ওঁকার, নানা দেবদেবীর মূর্তি, রাসলীলা, নানা পৌরাণিক চিত্র ইত্যাদি ফুটে উঠতো। হয়তো বা দেওয়ালে তাকিয়ে আছেন দেওয়ালে নানান ছবি ফুটে উঠতো, হয়তো মেঝের উপর কোন কাপড় বিছিয়েছেন তার উপর এই সমস্ত ফুটে উঠতো। যা ফুটে উঠতো তা তিনি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পেতো না। তিনি সেই সমস্ত ওঁকার বা ছবির উপর পেন্সল বা কালি বুলিয়ে সেটাকে সাধারণের দৃষ্টিগোচর করতেন। কোনদিন ছবি আাঁকতে জানতেন না। কিন্তু তাঁর সেই পেন্সিল দিয়ে আঁকা ছবি দেখলে যে কেউ বলবে বড় আর্টিস্ট ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি কিছু ঐ রকম ছবি আঁকা কাপড় এনেছেন, বাবাকে দেখালেন, আমরাও দেখলাম – বড় অদ্ভুত ব্যাপার।

বাবা বললেন – ‘‘জীবনে এরকম কখনও দেখিনি, এরকম কখনও শুনিনি।’’

আরও আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল তিনি ১৩ বছর বয়সে স্বামী … (অমুকের) কাছে মন্ত্র নেন (এখন বয়স প্রায় ৫০/৫৫) তারপর থেকে তাঁর সাথে দেখা করেননি। মন্ত্রের পর তিনি যতবারই তাঁর গুরুদেবকে পত্র দেন তাঁর – আশ্রমের ঠিকানায়, তত বারই পত্রে উত্তর আমাদের বাবার কাছ থেকে যায়।

বাবাও বল্‌লেন – ‘‘এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার।’’ জিজ্ঞাস করে জানলেন – মন্ত্রে ওঁকার আছে। মায়ীটি বাবার কাছে মন্ত্রের সংশোধন এবং বাবাকেই গুরুরূপে পাবার প্রার্থনা করলে বাবা পরদিন সকালে তাকে আসন নিয়ে আসতে বললেন।

শ্যামসংঘের ছেলারা এসেছে, আরও স্থানীয় কিছু ভক্ত এসেছেন। বাবা বলতে শুরু করলেন –  ‘‘আমি কে?… প্রকৃতি কে? … পরমাণু কি রকম? … পঞ্চীকরণ … সেই বিরাট পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থকে বৈশ্য এবং চরণ থেকে শূদ্রের উৎপত্তি … মানব জন্মের আগে পশুপক্ষী বৃক্ষলতা কুকুর ছাগল গরু প্রভৃতি হয়। এরপর স্থূলদেহ… সূক্ষ্মদেহ … কর্ণ ইন্দ্রিয়… ইত্যাদি। কারণ দেহ হ’ল ‘আমি দেহ’ এই বোধ। বর্তমানে বিশ্বের যে অবস্থা চলেছে তাতে মানুষ সূক্ষ্ম, কারণের কথা ভুলে গিয়ে স্থূল দেহকেই ‘আমি’ মনে করে দেহের সুখে ব্যস্ত। ‘আমি’ ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমার’ করে তারা যন্ত্রণা ভোগ করছে। শাস্ত্র বলে – যে দেহকে আমি মনে করে – সে পশু, গাধা। স্থূল – সূক্ষ্ম – কারণের অতীত তুমি। মাতৃগর্ভে পিতার ঔরসে স্থূলদেহ তৈরী হয়; কিভাবে হয় তারও হিসেব আছে। ১ মাসে এই, দু-মাসে এই – এভাবে ৯মাসে পূর্ণ হয়। তখন তার জ্ঞানের উদয় হল – এবার জন্ম হলে তোমার ভজনা করবো – এই তাদের আকুল প্রার্থনা। ৮০ লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে তবে মানব জন্ম, ক্রমে উচ্চবর্ণ প্রাপ্ত হয় কিন্তু ভূমিষ্ঠ হয়েই তারা মায়ার কৌশলে পূর্বস্মৃতি ভ্রষ্ট হয়। যাই হোক, ক্রমে স্থূলদেহ বড় হলে গুরুদেব কর্ণযোনিতে মন্ত্র দেন। এতদিন তার সূক্ষ্মদেহ ছড়ানো ছিল, মন্ত্রজপ করতে করতে তা জমাট বাঁধে – জ্যোতির আবির্ভাব হয়। কুলকুন্ডলিনী শক্তি … নাদ, শিষ্য আকাশময়ী কারণ দেহ লাভ করে। তারপর কোটিসূর্য্যসম বিন্দু ‘আমি’। মানুষ যেটাকে আমি বলে সেটি স্থূল। … লক্ষ্য হল আমিকে পাওয়া … এ তত্ত্ব বড় কঠিন তত্ত্ব। মূল কথা হল পৌঁছুতে হবে সেখানে। এ পথে পা বাড়ালে ক্রমে ক্রমে সব আপনা-আপনি হবে। সংসারের সঙ্গে অখাপ খাওয়াবে না, কারণ পিতামাতা ভগবান ভগবতী আমরা তাঁর দাসদাসী, সংসার ভগবানের আমরা তাঁর দাসদাসী এই ভাব নিয়ে চলতে হবে। জগতে যা কিছু আছে সব ভগবান ছাড়া আর কিছু নয় … সব সময় উপকার করবার চেষ্টা করবে, উপকার মানে পরোপকার। পরোপকার এভাবেও হয়, গাড়ীতে হয়তো বসে যাচ্ছ অন্য আর একজন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, নিজে দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দেওয়া, কেউ হয়তো একটা পয়সা চাইলে হয়তো বলার ইচ্ছা হবে ‘জোয়ান ছেলে খেটে খাওনাগে বাপু’ – তা না বলে একটি পয়সা হাতে দিয়ে দেওয়া। পথে চলতে গেলে ভুল ত হবেই, তবে চেষ্টা করতে হবে।’’

২১শে শ্রাবণ লেখা বিপুলদার ভাষায় শ্রীশ্রীঠাকুর সংবাদটি এখানে দিচ্ছি।

‘ভাব বিভোর শ্রীশ্রীঠাকুরের দিনগুলি কাশীতে অতিবাহিত হচ্ছে একই-ভাবে। শ্রী বিগ্রহের মোটামুটি কুশল। এক বৃহত্তর সত্ত্বার উপলব্ধির মধ্যে বসে রয়েছেন আনন্দাসনে। লোক সঙ্গ বর্জনে বদ্ধপরিকর। দর্শনার্থীর দল নিরাশ হচ্ছেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের শয্যাপার্শ্বে বই-এর সারি অন্তর্হিত হয়েছে। একদিন খোঁজ নিলেন মোটা হরফের দেবনাগরীর ছাপা গীতা প্রেসের নিত্যসঙ্গী গীতাটি। বল্‌লেন – ‘‘নাই বা পড়া হল – গীতাটি কাছে রাখতে ক্ষতি কি? আর একদিন চাইলেন – মিলনযজ্ঞ, বিজনেবিজয়া, কথা রামায়ণ। আস্বাদন করলেন স্বরচিত বইগুলি – স্থির নিবদ্ধ দুই চক্ষুতে ‘লীলাচিন্তার’ দীপ্তি নিয়ে। গীতাপাঠ কিন্তু হল না আরম্ভেই বিহ্বল হয়ে পড়লেন – অন্তরের মধ্যে ডুবে গিয়ে অবশ হলেন।

মৌনভঙ্গ করেছেন, যদিও সারাদিন কথা বলছেন সামন্য। আহার্য নিচ্ছেন আরও সামান্য। বলছেন ‘‘আহার তো নয় যেন প্রহার।’’ প্রচ্ছন্ন রহস্যের সুরে একদিন বললেন – ‘‘এর প্রতিদিন তিনটে ফাঁড়া – সকালে ফল ভোগ, মধ্যাহ্নে অন্নভোগ, আর শেষ-রাতের ভোগ-’’

দাক্ষিণাত্যের শেষ সীমায় কন্যাকুমারীতে আশ্রম স্থাপনের পরিকল্পনা রূপায়ণের প্রথম পদক্ষেপের শুভবার্ত্তাটি … যথাসময়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কর্ণগোচর করা হলো। ভাগীরথী মঠের অনুরূপ হিমালয়ের আর এক কোলে শ্রীশ্রীবদ্রীনাথ ধামে মঠ স্থাপনের প্রস্তাব তৃপ্তিভরা হাসিমুখে শ্রীশ্রীঠাকুর জানালেন – ‘‘উত্তম প্রস্তাব, ঠাকুরের ইচ্ছা হলেই হবে।’’ মাধবস্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন – এত মঠ মন্দির আশ্রম – এদের রক্ষা কি ভাবে হবে? ঈশ্বর বিশ্বাসের লাবণ্যমাখা সুরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন – ‘‘যদুপতে ক্ক গতা মথুরাপুরী রঘুপতে ক্ক গতোত্তর কোশলা। ইতিবিচিন্ত্য কুরুস্ব মন স্থিরং ন সদিদং জগদিত্যবধারয়।।’’

‘বাবা প্রয়াগে আমাদের কোন আশ্রম নাই’ – মাধবস্বামী জানালেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর – ‘‘সবই যদি বাবা করবে ছেলেরা কি করবে!