পত্রসেবা

বিবিধ || প্রকাশ কাল - April 18 2018


ওঁ হরিঃ

শ্রীবৃন্দাবন

পরম কল্যাণীয়াসু,

মাই, তোমার পত্র পাইয়াছি। পূজা করিবার নিমিত্ত আমি ত তোমাকে কোন ঠাকুর বিগ্রহ দেই নাই। অপরের নিকট তুমি ঠাকুর পাইয়াছ, কিন্তু সেই ঠাকুর একদিন পূজা করিয়াছ, তিনি ত তোমার কোন অনিষ্ট করেন নাই। আর ঠাকুরের পূজা কর কি কেবল সংসারের ভোগ বিষয়ে উন্নতির নিমিত্ত? ইহাত প্রকৃত ভক্তি নহে, এক প্রকার দোকানদারী। ভগবান্‌কে যে চায়, তাহাকে ত অপর সমস্ত বিষয়ে অাসক্তি পরিত্যাগ করিয়া অন্ততঃ অন্তরে ফকির হইতে হয়, তবে ত তাঁহাকে পাওয়া যায়। ভাগবতের একটি শ্লোকের অনুবাদ বাঙ্গালায় একজন নিম্নলিখিতরূপে করিয়াছেন। ভগবন্‌ বলিলেন, ‘‘যে করে আমার আশ, তার করি আমি সর্বনাশ। তবু যদি না ছাড়ে আশ, তবে হই তার দাসের দাস।’’ সংসারের প্রেমেও এইটিই নিয়ম, বিশেষরূপে বিবেচনা করিলে বুঝিতে পারিবে।

আর সংসারের সুখদুঃখের কথা বলিতেছ, তৎসম্বন্ধে ইহা নিশ্চিত জানিবে যে, এই জীবনের সুখদুঃখ প্রায় সমস্তই পূর্ব্বের কোন জন্মের ফল। এই জন্মে যে কর্ম্ম করা যায়, প্রায় তাহার ফল লোকে জন্মান্তরে ভোগ করে, খুব অধিক পুণ্য অথবা পাপ হইলে, তাহা ইহজন্মেরই ফল দিতে পারে, কিন্তু ইহা সাধারণ নিয়ম নহে। তোমার পালিতা কন্যা বল, অপর আত্মীয় বল, তাহারা জন্মান্তরে নিজ নিজ কর্ম্মফল ভোগ করিবে। তাহা বারণ করিতে তোমার সামর্থ্য নাই। তুমি তজ্জন্য দুঃখভোগ নিজে করিলে, ইহা বুদ্ধির কার্য্য নহে। সাংসারিক সকলের সহিত সম্বন্ধই অল্প দিনের নিমিত্ত, ইহা ভঙ্গ হইবেই, তখন কে কোথায় নিজ কর্ম্মের দ্বারা চালিত হইয়া যাইবে, তাহার কোন স্থিরতা নাই। এই সাংসারিক সম্বন্ধকে স্থায়ী মনে করিয়া যাহারা ইহাতে আসক্ত হয় – তাহারা শান্তি কিরূপে পাইবে? তুমি এই সকল ভালরূপে বিবেচনা করিবে। আমার আশীর্ব্বাদ জানিবে।

অত্র মঙ্গল।

ইতি

অশীর্ব্বাদক, শ্রীসন্তদাস

 

৩৪২

ওঁ হরিঃ

শ্রীবৃন্দাবন, ১লা বৈশাখ

পরম কল্যাণীয়াসু,

মাই, তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি আমার আশীর্ব্বাদ জানিবে। আবার নিয়ম যতদূর সম্ভব হয় নিষ্ঠাপূর্বক প্রতিপালন করা উচিত। যদি একান্ত অসুবিধা হয়, তবে আর কি করিবে? তজ্জন্য ভগবানের নিকট হাত জোড় করিয়া অসমর্থতা নিবেদন করিয়া দিবে। আর ভগবানের নিমিত্ত কিচু ক্লেশকর কার্য্য করিলে তিনি তাহার ক্লেশ দূর করিয়া দেন। যাহারা কার্য্যর দোষ দর্শন করে তাহারাও ক্রমশঃ বুঝিতে পারে এবং শান্ত হইয়া যায়। ভজন নিষ্ঠাপূর্বক করিতে থাক, ক্রমশঃ সকল বিষয়ে কল্যাণ লাভ করিবে। আমার শরীর একপ্রকার ভালই আছে।

ইতি

আশীর্ব্বাদক, শ্রীসন্তদাস

 

ওঁ হরিঃ

শ্রীবৃন্দাবন

১৮/১৩/৩০ ইং

পরম কল্যাণবরেষু,

প্রিয়, তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি কোনপ্রকার চিন্তিত হইও না। যাহা করিতেছ এবং যেরূপ চলিতেছে তৎসমস্তই ভগবদনুমোদিত বলিয়া জানিবে। সুতরাং কোন  প্রকার বিষণ্ণ থাকিও না। আনন্দমনে যথাসাধ্য কার্য্য করিয়া যাও। ঘরে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখিলে তাহা কোন প্রকারে নিজের মনে লাগিতে দিবে না, উড়াইয়া দিবে, অগ্রাহ্য করিবে। ইহার দ্বারা তোমার ধৈর্য্যকেই ভগবান্‌ দৃঢ় করিবেন। অত্র মঙ্গল।

 

ওঁ হরিঃ

এটাওয়া

২৮/১২/৩৪ ইং

পরম কল্যাণবরেষু,

প্রিয়, তোমার একটি পুত্র জন্মাইয়াছে সুখের খবর। পুত্রটি দীর্ঘায়ু হইয়া তোমাদের সুখ দান করে, ইহা অবশ্য আমি ইচ্ছা করি। পরন্তু তুমি উচ্চ সাধন প্রাপ্ত হইয়াছ।

তোমার পক্ষে ইহা সর্ব্বদাই মনে রাখিতে চেষ্টা করা কর্ত্তব্য যে, সাংসারিক সমস্ত বিষয়ই অনিত্য; কাহারও সহিত এবং কিসেরও সহিত, তোমার সম্বন্ধ চিরস্থায়ী নয়। যে সম্বন্ধ এই ক্ষণে আছে, তাহা এক সময়ে নিশ্চয়ই ভঙ্গ হইবে। ইহা জানিয়া কাহার অথবা কিছুরই প্রতি অত্যন্ত আসক্তিযুক্ত না হওয়াই শ্রেয়স্কর। সকলেরই কল্যাণ ইচ্ছা করিবে; এবং যথাসাধ্য সেবা করিতে চেষ্টা করিবে; এবং বিধাতা পুরুষ যেরূপ বিধান করেন, তাহা বাস্তবিকপক্ষে কল্যাণকর বলিয়া অন্তিমে প্রকাশ পাইবে, এই কথাটি সর্ব্বদা স্মরণ রাখিবে। অত্র মঙ্গল।

ইতি

আশীর্ব্বাদক, শ্রীসন্তদাস

 

ওঁ হরিঃ

মধুপুর,

বৃহস্পতিবার

পরম কল্যাণভাজনেষু,

প্রিয়, আপনার পত্র পাইয়া সমুদয় অবস্থা অবগত হইলাম। আপনি যে আপোষে আপনার নিজের মোকদ্দমা সকল নিষ্পত্তি করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন তাহা খুব ভাল। আপোষে হইলে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। মোকদ্দমায় জিত হওয়া অপেক্ষাও অনেক সময় শ্রেষ্ঠ; কারণ তাহাতে পরস্পরে ভাব থাকিয়া যায়, এবং মোকদ্দমার চিন্তা ও খাটুনি এবং ব্যয় হইতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। শ্রীমান্‌ – এর বিষয় সমস্ত অবগত হইলাম; যখন মোকদ্দমায় প্রবৃত্ত হইয়াছে তখন শেষ ফলে লাভ ক্ষতি গণনা করিয়া সাধ্য মতন শেষ পর্য্যন্ত সংগ্রাম করা উচিত, ফলাফল কোন মোকদ্দমারই নিশ্চয় নাই, ভাল মোকদ্দমায়ও খারাপ ফল হয়, খারাপেও ভাল ফল হয়; যিনি মনে করেন আমি নিশ্চয় জিতিব, তিনি অজ্ঞ। মোকদ্দমা নিজ বিচারে যথার্থ ও কর্ত্তব্য হইলে তাহার ফল কিরূপ হইবে তৎপ্রতি লক্ষ্য না করিয়া তাহাতে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। চাকুরী সম্বন্ধেও চেষ্টা এইরূপ বুদ্ধিতেই করা কর্ত্তব্য; তাহাতে অকৃতকার্য্য হইলেও চিত্তে ক্ষোভ আসে না। শ্রীমান্‌ – কেও বলিবেন যে রোগ হইলে সাধ্য মতন উপশমের  নিমিত্ত চেষ্টা করাই আয়ত্তাধীন বলা যায়; ফল কি হইবে তাহা কোন বিষয়ে কেহ স্থির করিতে পারে না; অতএব ফলের বিষয় পূর্ব্ব হইতে চিন্তা করিয়া চিত্তকে ক্লেশযুক্ত করা উচিত নহে। যখন ফল উপস্থিত হইবে তখন তাহা দেখিতেই পাইবে। তখন তৎসম্বন্ধে যদি কোন কর্ত্তব্য থাকে তবে করিবে। ইহাই সমস্ত কর্ম্মের রীতি, এই রীতি অবলম্বন করিলে ক্লেশ কম হয় এবং বিশেষতঃ আত্মার উন্নতি শীঘ্র হয়। আপনারা সকলে আমার আশীর্ব্বাদ জানিবেন।

ইতি

আশীর্ব্বাদক, শ্রীসন্তদাস

 

ঁ৭শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ।

শ্রীরামাশ্রম

ডুমুরদহ ১/১২/৪৯

অশেষ মঙ্গলালয়

বাবা, আজ উঠে তোর পত্র পেলাম, পত্রপাঠে বিবৃত অবগত হলাম। চন্ডীচরণের স্বর্গীয় আত্মা শান্তি লাভ করুক। শিবু কোথায় – কেমন আছে? তোরা কেমন আছিস? ঠাকুরের আশীর্ব্বাদ জানবি। জানাবি।

তোর মনের অবস্থা শুনিয়া আনন্দিত হইলাম। এই হাহাকার স্থায়ী হ’ক, বৈরাগ্য এবং অভ্যাস – এই দুইটি পরমা শান্তি লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। ভগবান শ্রীগীতায় বলেছেন – ‘অভ্যাসাৎ বৈরাগ্যচ্চ’ পাতঞ্জল – ‘অভ্যাস-বৈরাগ্যাভ্যাম্‌ তন্নিরোধঃ।’ বেদান্ত বলিয়াছে – ‘জনন-মরণাদি সংসারানলসন্তপ্তো, দীপ্তশিরা জলরাশিমিবোপহারপানিঃ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠং গুরুমুপসৃত্য তমনুরসতি’ – মস্তক জ্বলিয়া উঠিলে লোক যেমন সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া জলসমীপে গমন করে, সেইরূপ সংসারানল – সন্তপ্ত শিষ্য ব্রহ্মনিষ্ঠ আচার্য্যর অনুসরণ করিবে। এই অবস্থা না আসা পর্য্যন্ত কোন উপদেশ কার্য্যকরী হয় না। শ্রদ্ধা, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্যাদি সাধনার প্রাণ। শ্রদ্ধা ও তপস্যা হীনকে যে উপদেশ দেওয়া হয় সে উপদেশ কার্য্যকর হয় না। চাই শ্রদ্ধা, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য।

তোর ওপর ঠাকুরের কি অপার করুণা তা একদিন নিশ্চয়ই বুঝতে পারিবি। একবার অতীত জীবনের যথেচ্ছ আহারের কথা চিন্তা কর। ২৪ ঘন্টার মধ্যে জপ ধ্যান কয় ঘন্টা দিচ্ছিস? এখন মন স্থির হইলে, জ্ঞান চক্ষু খুলিয়া যাইলে, কোম্পানীর কাজেরই অসুবিধা হইবে – তোর কিছু হবে না। ‘আমায় মহাপ্রাণে প্রতিষ্ঠিত করে দিন’ – লিখেছিস্‌। এর মানে বুঝিস? যেমন সমস্ত নদী সাগরে যাইয়া একীভূত হইয়া যায়, তাহাদের পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি সমস্ত মন্ত্র গিয়া ‘প্রণবে’ বিলীন হয়। ‘প্রণব’ই হলেন ‘মহাপ্রাণ’। মন্ত্র চৈতন্য করিয়া দিয়াছি। মন্ত্রের কার্য্য আরম্ভ হইয়াছে ‘মন্ত্রের সাধন কি শরীর পতন’ – এই বলিয়া জোর দে। মন্ত্র শেষ করিয়া ফেল। মা আসিয়া দর্শন দান করুন। তবে তো শান্তি পাবি রে। একটু ছিঁটে ফোঁটা শান্তিতে কি হবে। জপ ধ্যান কতক্ষণ করিস? আরও সময় বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা কর। সগুন সমাধি লাভের পর মহাপ্রাণের প্রতিষ্ঠা হয় – তহারই নাম জীবন্মুক্তি। তোর প্রার্থনা শুনে আনন্দিত হলাম। আমার একবার যেতে ইচ্ছা করছে। ৭/৮ দিন পরে হয়ত এখান হ’তে বেরুতে হবে।  উঠেছি যখন, তখন বসা চলিবে না। এবার ১টি ২টি সঙ্গীর সহিতই যাবার ইচ্ছা রহিল। তারপর ঠাকুরের ইচ্ছা।

‘প্রত্যাহারাদ সমাধের্নাদভূমিঃ প্রকীর্ত্তিকা’ – প্রত্যাহার হইতে সমাধি পর্যন্ত্য নাদভূমি। ‘সর্বচিন্তাং পরিত্যজ্য সাবধানেন চেতসা নাদেবানুসন্ধেয়ো’ যোগসাম্রাজ্যলিপ্সুর নাদেরই অনুসন্ধান করা উচিত। জপ ঠিক হচ্ছে। সময় বাড়িয়ে দে। এখন গোলামি ছাড়লে চলবে না। গোলামি ও জপ-ধ্যান দুই-ই করতে হবে।

ব্রহ্মবিষ্ণুশিবাদীনাং শিরোরত্ন পদাম্বুজ।

কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেব কলৌযুগে।

সর্বেষাং দেবী মন্ত্রাণাং শ্রেষ্ঠত্বং কালিকামনু

যস্য গ্রহণ মাত্রেন জীবন্মুক্তোহধমোঽপি চ।।

(পিচ্ছিলাতন্ত্র)

– বহ্মাবিষ্ণু শিবাদির মস্তকমণি যাঁহার চরণ রাখিবার আধার সেই কালী ভিন্ন কলিযুগে অন্য কিছু নাই। সমস্ত দেবীমন্ত্র মধ্যে কালিকা-মন্ত্রই শ্রেষ্ঠ যাহার গ্রহণ মাত্রে অতি অধমও জীবন্মুক্ত হয় –

কালিকা মোক্ষদা দেবী কলৌ শীঘ্র ফলপ্রদা

গুরোর্মুখান্মহাবিদ্যাং গৃহ্নীয়াৎ পাপনাশিনীম্‌।

(কুব্জিকা তন্ত্র)

– মোক্ষদায়িনী কালিকা কলিযুগে শীঘ্র ফল প্রদান করেন।

সেই পাপনাশিনী মহাবিদ্যা গুরুর মুখ হইতে গ্রহণ করিবে।

কিমধিকমিতি।

শিবার্থি – শ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথ।