শ্রীসীতারামকথামৃতম্

কিঙ্করী কৃষ্ণপ্রিয়া || প্রকাশ কাল - April 18 2018

১৩৮৩ সালের বৈশাখ ২৪ তারিখের শেষরাতে শ্রীশ্রীঠাকুর শৌচান্তে এসে বসেই শরু করেন – মানুষের আজ কি দুঃখ। রোগে শোকে জ্বালায় যন্ত্রণায় একটা যেতে না যেতে আর একটা দুঃখ, কারণ কি? – অজ্ঞান। অজ্ঞান হল – দেহোহহমিতি যা বুদ্ধিরবিদ্যা সা প্রকীর্ত্তিতা।

নাহং দেহশ্চিদাত্মেতি বুদ্ধি র্বিদ্যোতি ভন্যতে।

দেহ আমি – এই অজ্ঞান আর আমি দেহ নই এটীই হল বিদ্যা। রোগের কারণ কি? দুঃখ থাকে কোথায়? ‘আমি দেহ’ এই বোধই দুঃখের কারণ। আমি দেহ নই চিদাত্মা, তিনি কোথায় থাকেন?  তাও তো জানি না, অনুভব করছি তো আমি দেব। জ্ঞানমুৎপদ্যতে পুংসাং – পাপক্ষয় হয়ে যায় জ্ঞান হলে।

কালে সব ক্ষয় হয়ে যায়, চেষ্টা করতে হবে না।

কালেন দুরিতক্ষয়ে স্বয়মেব হি সিধ্যতি।

যারা এপথে পৌঁছাতে চায় তাদের প্রাকৃত লোকের সঙ্গ একেবারে ত্যাগ করা উচিৎ।

সাপের মত ভয় করে দূরে থাকতে হয়।

অহেরিব গণাদ্ভীতো মিষ্টান্নাচ্চ বিষাদিব।

রাক্ষসীভ্যঃ ইব স্ত্রীভ্যঃ স বিদ্যামধিগচ্ছতি।।

তবে সৎসঙ্গের কথা আলাদা। গুড় চিনি রসগোল্লা সব বিষের মত লাগবে। পার না? একটু একটু করে কমাও রাক্ষসীর ন্যায় স্ত্রীলোক মনে করবে আবার এদিককার হল ‘রাক্ষসেভ্য ইব পুংভ্যঃ’ পুরুষকে রাক্ষস মনে করে সরে থাকবে।

কোন জিনিষ ত্যাগ একেবারে হয় না, অল্প অল্প করে ছাড়তে হয়। এমন কি স্ত্রীলোক দেখলেই মা যদি বলি তবুও হয় না এমন দুর্নিবার আকর্ষণ। যতক্ষণ ভোক্তা ভোগ্য ভাব আছে ততক্ষণ এই আকর্ষণ যায় না। যা পরে বলা যাবে।

জ্ঞান কি – আমি দেহ নই। যদি বল আমি দেহ – তো বল দেহের কোনখানটা আমি। আমার হাত, আমার পা, আমার বাবা, আমার বাড়ী সব তো আমার বলছ তবে তুমি কই? এই আমার কর্ত্তা, ‘আমি’ টি কোথায়?

শাস্ত্রই খোঁজ দিতে পারে ‘আমি’ কোথায়। শাস্ত্রে আছে প্রত্যেক মানুষের তিনটি দেহ স্থূল, সূক্ষ্ম কারণ। সূক্ষ্ম ও কারণ দেহ অপঞ্জীকৃত পঞ্চভূত দিয়ে তৈরী। আর সেই সূক্ষ্ম পঞ্চভূত পঞ্চীকরণ করে তৈরী হল সূস্থদেহ। এই যে দেহটা দেখা যাচ্ছে এটা হল স্থূলদেহ এর ভেতর আছে সূক্ষ্ম ও করণ। এতেও হল না – ‘মমৈবাংশা জীবলোকে জীবভূতঃসনাতনঃ’।

আমারই নিত্যসিদ্ধ অংশ অবিদ্যা কর্ত্তৃক জীবরূপে পরিণত হয়।

শুনলাম তো, কিন্তু ঐ পঞ্চীকৃত, অপঞ্চীকৃতই বা কি ওসব ভাল বুঝি না। যখন কৃষ্ণচন্দ্র এসেছিলেন তিনি জানতেন এ অবস্থা আসবে তাই সমস্ত শাস্ত্র মন্থন করে সার গীতামৃত দিয়ে গেছেন।

তিনি বলেছেন – গীতার সপ্তম অধ্যায়ে

‘ভূমিরাপোহনলোবায়ু খং মনো বুদ্ধিরেব চ।

অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্ন প্রকৃতিরষ্টধা।।

অপরেয়মিতস্ত্বন্যাংপ্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্‌।

জীবভূতাংমহাবাহো যয়দং ধার্য্যতে জগৎ।।

আমার পরা অপরা দুই প্রকৃতি আছে – এই দিয়ে জগৎ চলছে। অংশরূপে তিনি সুষুম্নার মধ্যে আছেন। তিনি বাক্‌রূপে আবার দেহটিকে ধরে রেখেছেন – বাগেব বিশ্বা ভুবনানি জজ্ঞে – মূলাধারে পরা, নাভিতে পশ্যন্তি, মধ্যমায় অনাহত, মুখে বৈখরীরূপে শব্দব্রহ্ম বিরাজিত।

সুষুম্না শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে পদ্মের মৃণালের মতো সরু সুতোর মত গেছে। ধ্যানের সময় এই সুষুম্নাকে চার আঙ্গুল চওড়া ধ্যান করতে হয়। এই ব্রহ্মরেখা মূলাধার থেকে সূর্যমন্ডল বিরজা নদীর এপার পর্যন্ত বিস্তৃত। দেহে কয়েকটি পদ্ম আছে তার মধ্যে মূলাধারে চতুর্দ্দল পদ্ম আছে। তার বীজকোষে একটি ত্রিকোণ মন্ডলে শিবলিঙ্গ আছেন। সাড়ে তিন প্যাঁচ ঘিরে ঘুমিয়ে আছেন কুন্ডলিনী। শিবের মাঝখানটি ফাঁপা তার মাঝখান দিয়েই সুষু্ম্না আছেন। সর্পাকারা কুন্ডলিনী – তার দুটি মুখ। আমরা ঘুমোচ্ছি ঝগড়া করছি সব সেই লেজোমুখের কাজ আর একটি মুখ চেপে ঘুমোচ্ছেন। যতদিন না জাগেন ততদিন বদ্ধজীর হয়ে থাকতে হবে।

ইনি মূলাধারে ব্রহ্মদ্বার রোধ করে নিদ্রিতা। ইনি গুরুকৃপায় জাগরিত হলেই তবে জীবের যাতায়াত নিবৃত্তি হয়।

‘‘জাগো মা জগজ্জননী তারিণী

তুমি না জাগিলে শিবে, বল কিবা ফল হবে?

বিফলে বহিয়া যায় জীবন রজনী।

মূলাধারে জ্যোতিরূপা শিবালয়ে আছ শুয়ে

কাতর তনয় ডাকে বারেক না দেখ চেয়ে।

সার্দ্ধ ত্রিবলয়াকারে শঙ্করে আছ মা ঘিরে,

চারিদল কমলেতে চঞ্চলারূপিণী।

বিফল পূজা জপ ঘুমায়ে থাকিলে তুমি।

কতবার ঘুরিতেছি তাই মা জঠর ভূমি।

নিলাম শরণ মাগো রাতুল চরণে তব

জাগিয়ে তার মা তারা না আসিতে দিনমণি।

‘‘আমি তোমরা শরণাগত’’ বলে ডাকলেও হবে, বা শুধু মা – মা – মা – বলে ডাকলেই জেগে যাবে।

জীব ৫ রকমের – নিত্য, মুক্ত, বদ্ধ, কেবল, মুমুক্ষু। বদ্ধজীব সর্ব্বদা ‘আমার আমার’ করে কাঁদছে। অমুক মরেছে গো! আহা একমাত্র ছেলে মরে গেল? আমরাই যে মরবো না কে বলেছে – একাবার সে কথা ভাবিনা – কি লেখাপড়া করে এসেছে মরবে না।

তোমারও এমন দিন আসতে পারে। শাস্ত্রে আমরা কি পেয়েছি – ভগবানের দুই প্রকৃতি – পরা, অপরা। পরা প্রকৃতি আমি – কুন্ডলিনী শক্তিরূপে আছি তোর দেহে। আবার অনন্ত কোটী ব্রহ্মান্ড তাঁরই একপাদে ভাসছে। ব্রহ্মান্ডের পরিমাণ কি রকম – পৃথিবীর পরিমাণ ২০০ কোটী ক্রোশ তার চারদিক ঘিরে দশগুণ জল, তার দশগুণ তেজ, তার দশগুণ বাতাস, তার দশগুণ আকাশ, তার দশগুণ প্রকৃতি – এই হল একটী ব্রহ্মান্ড – ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ত্রসরেণুর মত ভসছে। অন্য তিন পাদের খোঁজই নেই। মন পৌঁছাল না। আকাশের মত ব্যেপে আছি – না পারলাম না ধরতে।

আচ্ছা, জলের মত, গঙ্গার মত?

হ্যাঁ, এবার বুঝতে পারি। তার মধ্যে আমি ডুবে আছি। এটী হল নির্গুণ ভাব। ভগবানকে চারভাবা পাই।

১) নিগুঁণ।

২) সগুণ ভাব হল গোলোক বৈকুন্ঠে লক্ষ্মীনারায়ণ আছেন। কৈলাসে হর-পার্ব্বতা। বিভিন্ন দেবদেবীরূপে সগুরূপে বিরাজ করছেন।

৩) আত্মা-দেহত্রয়ে বদ্ধ হয়ে আছেন।

৪) অবতার – রামচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্র এঁরা। কৃষ্ণচন্দ্র ১২৫ বছর ছিলেন। একটী নির্দ্দষ্ট সময় এঁরা কাজ করে যান, সেই লীলা চিন্তা করে মানুষ কৃতার্থ হয়। অর্চ্চাবতার চিরকাল আছেন – শালগ্রামশিলা, অধিকার যার আছে সেবা দ্বারা তার অপরা প্রকৃতি চলে যায়। অপরা প্রকৃতি হলো রজঃ তম। অনেক লিঙ্গ আছেন অর্চ্চাবতার। যেমন সৈদ্ধলিঙ্গ কোন সিদ্ধপুরুষ স্থাপন করেছেন। বা কোন একটী স্ত্রী গোপাল বা গোবিন্দ সেবা পূজা করেন তাতেই সমস্ত গুণ শক্তি আছে।

ভগবানের অপার প্রকৃতি পঞ্চীকরণ করে স্থূল দেহ হয়ে গেছে, ভগবান আমার মেরুদন্ডের মধ্যে আছেন। বলছি আমার এটী ওটী হলে ভাল হয়।

আমাকে আমি ভুলে গেছি তো। এই বাইরের চাওয়াটাই তো দুঃখ। ভোগের জিনিষ পেলে দুঃখ তো দূর হল না – মারের চোটে গন্ধফুল ফুটে গেছে। ইন্দ্রিয় সর্ব্বদা ভোগ চাচ্ছে বার থেকে নোব। একখানা সুন্দর মুখ দেখে ছোটা হল পরে তা রাগে কুৎসিৎ হয়ে যেতে পারে, খসে যেতে পারে, বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, মরে যেতে পারে।

চার আঙ্গুল জিহ্বাতে খাওয়ার ব্যাপার কত। জিভে দেওয়ার আগেও নেই পরেও নেই। ডিমের ডালনা খাচ্ছি কি বেগুন পোড়া খাচ্ছি। এই চার আঙ্গুল জিভের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ব্যস্‌।

‘‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবাস্মৃতিঃ স্মৃতিঃ প্রতিলম্ভে সর্ব্বগ্রন্থিনাং বিপ্রমোক্ষঃ।’’

আহারশুদ্ধি হতে সত্ত্বশুদ্ধি হয়, তার দ্বারা ধ্রুবাস্মৃতি লাভ হয়। এই স্মৃতি দ্বারা সব গিটগুলো খুলে যায়। এমন কোন বন্ধু পাই না যে পথ বলে দেবে। কাউকে মনের মত পেলুম না, সবাই যেন রকম রকম। আরে তোর মনটাই তো মনের মত নয়।

আমি তোমার। তোমার মধ্যে ডুবে আছি। তুমি ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবরূপে ব্যাপ্ত, আমি তার মধ্যে ডুবে আছি। মাভৈঃ! তাঁর অভয়বাণী রয়েছে –

সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি য যাচতে।

অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ্‌ ব্রতং মম।

একবারও যে ‘আমি তোমার’ বলে, তাকে অভয় দান করা আমার ব্রত। স্থূলে কাজ করতে হলে স্থূলে নাবতে হবে। আমি যে কোন পথ পাচ্ছি না। কত লোভ কত কাম কত ময়লামাটি রয়েছে আমার কি হবে?

– নোব, আমি সব নোব।

-তোমার কিছু হবে না?

– না, সব নেব। গরু যেমন, বাছুরের গায়ে রক্ত, লালা চেটে চেটে সাফ করে তেমনি – তবে তোমায় এই গুলি করতে হবে।

শুদ্ধাহার সদাচার কালে উপাসন।।

তাতেই লভিবে প্রিয় সাক্ষাৎ দর্শন।।

শুদ্ধাহার – ভগবানকে নিবেদন করে খেতে হবে, যখনই যা খাওয়া হোক্‌ না কেন! যার তার হাতে যখন তখন খাবে!

সদাচার – প্রতঃস্নান মহাতপস্যা, স্নান সহ্য না হলে ভিজা গামছা দিয়ে হাত পা মুছে ফেলা। এই সঙ্গে হল শৌচ। জল মাটি দিয়ে শৌচ হল বাহ্য শৌচ। আন্তর শৌচে আছে মৈত্রী, মুদিতা করুণা, উপেক্ষা।

কালে উপাসনা – কাল হল সূর্য্যোদয়ের ২৪ মিনিট আগে থেকে ২৪ মিনিট পর পর্য্যন্ত, মধ্যাহ্নে ও সায়াহ্নে। এই সময়ে কি হয়। সব সাত্ত্বিক পরমাণু নবতে থাকে। এ সময় বসলে সাময়িক ভগবানের করুণা পাবে। সকালে সন্ধ্যার সময় এই সাত্ত্বিক পরমাণু নামে। এইরকম কামের পরমাণু আছে, ক্রোধের আছে সাহায্য করে। আরতির সময় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজছে সাত্ত্বিক পরমাণু নাবছে, ধুনো জ্বালানো হয়েছে সাত্ত্বিক পরমাণু নাবছে, হরে কৃষ্ণ নাম হচ্ছে, বিশ্বের কল্যাণ হোক্‌ বলা হল – অমনি সাত্ত্বিক পরমাণু নাবছে।

কই দেখতে পাচ্ছি না – তবে?

– তোমার আনন্দ হবে।

আচ্ছা, একটা মন্ত্র দেব। মন্ত্রের দক্ষিণা দিতে হবে সর্ব্বস্ব।

– আমি কি খাব তবে?

– সর্ব্বস্বং গুরবেদদ্যাৎ – সব দিতে হয়। নানা একেবারে আমি নিব না। প্রসাদী করে দেব।

মন্ত্রটী – পাঁচজনের বলে বা তন্ত্রসার আছে তো। একটা গুরুকরণ করে এঁটো খেতে হবে, প্রণামীও মোটা রকম দিতে হবে। কি দরকার?

একটা ছোট ছেলেকে যতক্ষণ না গুরুমশায় এসে বলে এটা অ এটা আ ততক্ষণ হবে না, যত বই হাজির করনা কেন? এই রকম সব লাইনেই গুরুর দরকার। বড় ডাক্তার হল, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, রাষ্ট্রপতি হল সবেতেই গুরু লাগবে। তারপর? এই চশমাটা থাকবে কাল সকাল পর্য্যন্ত প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি কিন্তু দেহটা? ১০ মিনিটের ঠিক নেই তিনি মন্ত্রী বা যেই হোন না কেন। তথাপি এই দেহের জন্য কত, আর যার দ্বারা জগৎটা বৈকুন্ঠ হয়ে যাবে তাতে গুরুর দরকার হবে না?

– আচ্ছা দিন মন্ত্র।

-‘‘রাম’’

– আরে ওতো ছেলেবেলা থেকেই শুনছি –

তবে শোন – একজন গরীব ব্রহ্মণ, বাড়ীতে খেতে অনেকগুলো। অভাবের তাড়নায় অস্থির হয়ে এক সাধুর পায়ে ধরে পড়ল একটা উপায় যা হোক্‌ করে দিতেই হবে। সাধু তার চাদরের খুঁটে একটা কাগজ মোড়ক বেঁধে দিয়ে বললেন – এটা বাঁ কাঁধে ফেললে শূন্যে উঠে যাবে আবার যেই ডান কাঁধে ফেলবে অমনি নেমে আসতে পারবে। সাবধান, খুলবে না, দেখবে না। ব্রাহ্মণ খুশী মনে চলে গেল। বাড়ী গিয়ে ভাবলে একবার পরীক্ষা করে দেখি তো, বলে যেই বাঁ কাঁধে ফেলেছে অমনি চড়্‌চড়্‌ করে আকাশে উঠে গেল। সকলে বললে নাববেন  কি করে? যেই সেটী ডান কাঁধে ফেলা অমনি মাটিতে নেবে এলো।

এবার ‘আমাকে মন্ত্র দিতে হবে’ বলে বহু শিষ্য জুটে গেল। এই রকম একটা দেখাতে পারলে আর শিষ্যের অভাব হবে না। ব্রাহ্মণের অভার তো থাকলোই না, বাড়ী, জমি, পুকুর, মায় ইলেকট্রিক লাইট, ইলেকট্রিক ফ্যান পর্য্যন্ত সব হল।

একদিন ব্রাহ্মণ এটা পুরোন হয়েছে বলে খুলে দেখে, এক টুকরো কাগজে ‘‘রাম’’ লেখা আছে। সেটা ফেলে দিয়ে আরেকটা ভালো কাগজে লালা কালি দিয়ে বড় বড় করে ‘র’ এ আকার ‘ম’ লিখলে। সেটা বেশ করে আঁচলে বেঁধে বাঁ কাঁধে ফললে, কিন্তু কই দেহ তো ওঠে না। হাতে চাপ দিয়েও উঠতে পরছে না –

যাও। ছুটলো সাধুর কাছে, কি হবে আর যে উঠতে পারছি না।

সধু বলেন – খুলেছিলে কি?

– আজ্ঞে হ্যাঁ, পুরোন হওয়াতে ফেলে নতুন করে লিখে –

– ওরে হতভাগ্য নিজের দুঃখ নিজেই বরণ করে নিলে। আমি শুধু ‘র’ এ আকার ‘ম’ রাম লিখিনি ওতে আমার সারা জীবনের তপস্যা ছিল।

তাই বলি গুরু ‘রাম’ দেন না সেই সঙ্গে তাঁর তপস্যাও দেন।

– কই আমরা কিছু তো হয় না।

তুমি কর না তাই হয় না। হ্যাঁ জপ করতে করতে কত শব্দ ‘‘গুরু গুরু, সোহহং’’ …

– এসব হয়? এসব কি শাস্ত্র কথা?

বলছেন ত হুঁ হুঁ।

হ্যাঁ, শাস্ত্রেই এসব আছে। কত আলো লাল নীল ছোট বড় গোল বিন্দু। যা বাইরে ছিল সব ভেতরে আছে তবে এরা অলৌকিক। ক্রমে সব অলৌকিক আসতে থাকে। এক ফোঁটা প্রেমাশ্রুতে সব আছে প্রাণটা ভরে উপচে যায়। যারা এ পথে চলে তারা মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করে চোখের জল যেদিন না এল কিছুই যেল হল না। দর্শনের ব্যাকুলতা এলো ভগবান দর্শন দিলেন না – না ওভাবে নয়, আমি যেভাবে দেখতে ভালবাসি ধনুর্ব্বাণ হাতে নবদূর্ব্বাদলশ্যামরূপে….।

সেভাবেই দর্শন হল। তিনি বললেন – বর নে।

– না বাবা, বর চাই না আর। ব্যস্‌ মন্ত্রময় দেহটা তাঁর মধ্যে লয় হয়ে গেল। বাইরেরটা ছিল হংস দেহেরটা সোহহং। সেই আমি চলে গেল আবির্ভাব হলেন ওঙ্কার। মন্ত্র উচ্চারণের সামর্থ্য চলে যায় – বলতে গেলে মন্ত্র গড়িয়ে গড়িয়ে যায় এসে দাঁড়ান ও – ও – ওম্‌। সমাধি।

এখানে তো আমি হয়ে আটক হয়েছিলাম। – বাইরের রূপ রসের পিছনে ছুটেছিলাম –

অলৌকিক রূপ রস গন্ধ স্পর্শ হয়ে তুমি এসে আমাকে গ্রাস করে ফলেলে। সমাধিতে আত্মা পরমাত্মায় মিশে গেলে জীব তখন হয় জীবন্মুক্ত। জীবন্মুক্ত দু-রকমের ব্রহ্মকোটী, ঈশ্বরকোটী। তখন আনন্দই তাঁদের স্বরূপ। আনন্দ কোথায় পেলেন?

– শাস্ত্রপথে।

আনন্দই তো ভগবান। বার জন্য বিজ্ঞাপন দিতে হবে না – তাঁর ভাব, ভাষা, ধারা, সারাজীবনে কর্ম্মনিষ্ঠা, শ্রদ্ধা, সব জানিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, কলেরা প্লেগের জীবাণুর মত তাঁর কাছে গেলেই আনন্দ। আনন্দর পরমাণু ছড়ায়।

আমি তোমারই। আগে আমি তোমরি। তোমার আলো এল আমার কালো ঘুঁচলো। প্রথম বদ্ধজীব – গুরু মন্ত্র দিয়ে সাধক করে দেন, তিলক দিয়ে অঙ্গ শুদ্ধ, তুলসীর মালা গলায় দিয়ে কন্ঠ শুদ্ধ করেন। ভগবান তুলসীকে ছেড়ে থাকেন না। যে তুলসী কানন করে, তাকে মুক্তি দেন।

এসব তো শুনলুম, ভুলে যাব। আরে আমি কি করবো বলুন।

আমি শরণাগত – এইভাবে নাম করতে হবে।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

আমি মুখ্যু বলে যা হোক্‌ বললেই হবে না। আচ্ছা প্রাণ বের হচ্ছেন অপান টানছেন এই ভাবে দেহটাকে ধরে রেখেছে। নিঃশ্বাস বারো আঙ্গুল পড়ে মোটামুটি এই হিসাব। বারো আঙ্গুল কমলেই হবে। যোগের সাহায্যে হতে পারে কিন্তু তার অনেক নিয়ম – ভোরবেলা স্নান করতে হবে, উপযুক্ত খাদ্য খেতে হবে। কোটী কোটী জীবের পক্ষে কি করে সম্ভব? তবে এত লোক কোন্‌ পথে আনন্দ লাভ করবে? – নাম।

হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্।

কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নস্ত্যেব গতিরন্যথা।।

কলিতে নাম ছাড়া গতি নাই নাই নাই।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

শ্বাস বারো আঙ্গুল আর পড়তে পারল না, দেহটা জমতে লাগলো। নাম করতে করতে নাদ এসে গেল, দশ আঙ্গুল নেবে এল – ক্রমে নানান্ নাদ আসতে লাগলো, সোহহং এলে নিঃশ্বাস আরও ছোট হয়ে পাঁচ আঙ্গুল হল – এরও কম হয়। ব্যাস্‌।

তবে ফুল ফোটে এরকম করে নয় (হাতের আঙ্গুল সব মেলে ধরে দেখাচ্ছেন, অর্থাৎ গোটাটা এক সঙ্গে নয়) ধীরে ধীরে। একটু একটু করে ফোটে। এতে নিরাশ হবার কিছু নাই। হও পাপী, হও তাপী – নাম কর, নাম কর – পাপ যাবে, তাপ যাবে, আনন্দসাগরে ডুবে যাবে। আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া নয় – করে দেখ – হবেই। বল –

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।